আরও একবার(৪র্থ পর্ব): জিৎ সরকার
আগের পর্বটি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
রুমির সাথে সায়কের প্রথম পরিচয় হয়েছিল হোটিলং এর কোর্স করার সময়। তারপর ধীরে ধীরে সখ্যতা গড়ে ওঠে। সায়কের আইডিয়াটা তার পছ্ন্দ হয়। রুমির বাবা খুব বড়োলোক তবে রুমি বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে কিছু একটা করতে চায়। সায়কও বন্ধুরূপী একটা ইনভেষ্টার পেয়ে যায়। তারা দুজন মিলে শুরু করে তাদের নতুন স্টার্ট আপ্।
অনুমিতা ইদানীং একটু একটু করে একাকীত্বে ভুগতে শুরু করেছে। তার মনে একটা চিন্তা দানা বাঁধছে, সায়কের পাশে তার জায়গাটা যেন রুমি একটু একটু করে কেড়ে নিচ্ছে। এমন একটা চিন্তার সঙ্গত কারণ আছে বইকি। সায়কের মুখে এখন উঠতে বসতে রুমির নাম শোনা যায়। সকালের ব্রেকফাস্টের সময় রুমির ফোন বা মেসেজে সারাদিনের কাজকর্মের ব্রিফিং দিয়ে সায়কের দিন শুরু হয়। এরপর রেস্তরাঁর কাজকর্মের দেখাশোনা তো আছেই তারপর সায়ক বাড়ি ফিরলে সেখানেও রুমি, কখনো সশরীরে কখনো বা ফোনের মাধ্যমে উপস্থিত। সারাদিনের লাভ-ক্ষতি, জমা-খরচের হিসেব করে তারা। অনুমিতার এই একটা জিনিসে ঘোর আপত্তি, কেন বাবা! বাইরে কাজকে রোজ রোজ বাড়িতে কেন টেনে আনা? বাইরে সেরে আসলেই তো হয়। অনুমিতা যদি একান্ত প্রয়োজন বোধ না করে তাহলে অফিসের কাজকে কোনোদিন বাড়িতে টেনে আনে না।
প্রথম দিকে অনুমিতার চোখ রাঙানিতেই বেশ কাজ হতো। পরে সেটা সায়কের গা-সওয়া হয়ে যায়। এরপর অনুমিতা বকাঝকা করতে শুরু করে, বেশি রাগ হয়ে গেলে নিজেই সায়কের ফোন কেড়ে নিয়ে কেটে দিতো কিংবা রুমি বেশি রাত পর্যন্ত থাকলে ওদের ডিস্টার্ব করার নানা ফন্দি করত। প্রথমদিকে এগুলোও সায়ক মেনে নিয়েছে তারপর তারও বিরক্তি লাগতে শুরু করে সেখান থেকে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। তারপর ক্রমশ রুমি আর সায়কের কথাবার্তা বলার জায়গাটা বদলে যায়, সায়কের বাড়ি থেকে রুমির ফ্ল্যাট। সায়কের বিয়ের মাস কয়েকের মধ্যেই সায়কের মা মারা যান স্ট্রোকে, উনি থাকলেও অনুমিতা কথা বলার একটা লোক পেত। সায়কের বাবা খুবই স্বল্পভাষী মানুষ, অবসর পাওয়ার পর সারাদিন বইয়ের জগতে মেতে থাকেন। তার সাথে বেশি কথা বলতে গেলে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যের থেকে বিরক্তি বোধ করেন বেশি। তনিমাও কিছুদিন হলো রেজিস্ট্রি বিয়ে সেরে নিয়েছে, অনুষ্ঠান করে বিয়েতে তার ঘোর আপত্তি ছিল, সেও তার নতুন সংসারে ব্যস্ত। ইদানীং অনুমিতা কেমন যেন চুপ মেরে গেছে। সায়ক যখন কাজ করে তখন সে মাঝে মাঝে তার পাশে বসে কেমন যেন বোবা দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে। বারকয়েক চেষ্টা করেছে সে কথা বলার, কিছু প্রশ্ন করেছে কিন্তু

সায়কের কাছ থেকে “হুঁ” বা “না” এর বেশি উত্তর সে পায়নি। আবার অনুমিতা কখনো কোনো ডিনার বা লাঞ্চ প্ল্যান করেছে একান্তই নিজেদের জন্য, সেখানেও রুমি ঢুকে পড়েছে কখনো কখনো; স্বেচ্ছায় অথবা সায়কের ইচ্ছাতে, তবে সবটাই কাজের অজুহাতে। এই সমস্ত নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক ঝামেলা হয়েছে বটে, তবে সায়ক নিজের সিন্ধান্ত থেকে একচুলও নড়েনি। এখন আর ঝগড়া করতেও ইচ্ছা করেনা অনুমিতার, কেমন যেন ক্লান্তি আসে। সেও এবার অফিসের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছে।
আজকাল যেন অনুমিতাকে কেমন অচেনা ঠেকে সায়কের। এখন তার যেন বাড়ির থেকে বাইরে দিকে মন বেশি। সায়কের সঙ্গে আর ভালোও করে কথাও বলে না, ঝগড়াও করে না। তবে একটা ব্যাপার সায়ক লক্ষ্য করেছে, ইদানীং সায়ক যদি অনুমিতার সামনে রুমির প্রশংসা করে তবে অনুমিতাও তার কলিগ রজত বোসের স্তুতি জুড়ে দেয় সায়ককে শুনিয়ে শুনিয়ে। সায়ক মাঝে মাঝে রেগে যায়, চেঁচামেচি জুড়ে দেয় অনুমিতার সঙ্গে, তবে অনুমিতার দিক থেকে উত্তেজনার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। সে শান্ত ভাবেই সমস্ত কথার উওর দেয়, কখনো বা ঠেস দিয়ে দুটো কথা বলে, ব্যস ওই পর্যন্ত। কয়েকবার সায়ক দেখেছে অনুমিতা আর রজত কে বিভিন্ন নামি রেস্তোরাঁ থেকে বেরোতে বা ঢুকতে। এইতো সেদিন সায়কের গাড়ি জ্যামে আটকে গেল, সায়ক ঘাড় ঘুরোতেই হঠাৎই চোখে পড়ল একটা ক্যাবে ওদের দুজনকে অনুমিতা আর রজত বোস। রজত হাত নেড়ে কী যেন বলছে আর হাসিতে ফেটে পড়ছে অনুমিতা। এরকমই অনেক কিছুই দেখেছে সায়ক তবে একদিনের ঘটনা সায়েকর ধৈর্য্য ভেঙে দেয়। সেদিন অনুমিতার জন্মদিন, সায়ক একটা কাজে শহরের বাইরে গেছে তার ফেরার কথা দুদিন পর, তবে কাজটা অর্ধেক শেষ করে বাকিটা রুমিকে বুঝিয়ে দিয়ে সায়ক সেদিনই ফিরে আসে। সে ভেবেছিল অনুমিতাকে চমকে দেবে, তাছাড়াও অনুমিতা এখন ক’দিন একাই থাকবে কারন সায়কের বাবা তাঁর বোনের বাড়ি গেছেন তাই তার সাথে মন খুলে কথা বলা যাবে। একটা বড়ো কেক নিয়ে সায়ক বাড়ির দরজায় পৌঁছে কলিং বেলটা বাজাল, তবে অনুমিতা দরজা খোলার পর সে নিজেই চমকে গেল। ঘরের ঠিক মাঝখানে টেবিলে একটা কেক কাটা অবস্থায় পড়ে আছে তার পাশে একটা ছুরি হাতে দাড়িয়ে রজত বোস, দরজার সামনে অনুমিতা তার গালে ক্রিম মাখানো।
আজ অনুমিতার জন্মদিন। সে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে আজ। কিছুদিন আগে সে ডাক্তার দেখিয়েছিল, ডাক্তার কয়েকটা টেস্ট দিয়েছিল, সেগুলো অনুমিতা করিয়ে ছিল কাউকে কিছু না জানিয়ে কারন তার মনে একটা সংশয় ছিল। তবে আজ ডাক্তার সেগুলো দেখানোর পর ডাক্তারের কথা শুনে তার সংশয় সত্যিতে পরিণত হয়েছে। তার জন্য সে অবশ্য খুবই খুশি। সে যেন একরাশ নতুন আনন্দের সন্ধান পেয়েছে। প্রথমে ভাবল আজই ফোন করে সায়ককে জানাবে সবটা তারপর ভাবল না থাক, দু’দিন পর সায়ক ফিরবে তখনি না হয়…। এবারে তার জন্মদিনে সায়ক না থাকলেও অনুমিতা তার নিজের জন্মদিনের স্মারক হিসেবে সায়ককে খুব দামি একটা উপহার দেবে, তাদের গত দুবছরের ভালোবাসার ফসল। এবার হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার আগের মতো সায়ককে ফিরে পাবে সে। সবটা হয়তো স্বাভাবিক হবে, আরও একবার।
সারাটা দিন আজ একাই কাটাতে চেয়েছে অনুমিতা, সায়কই যখন নেই তখন আর কাউকে চায় না। সোস্যাল মিডিয়াতে একপ্রস্থ শুভেচ্ছাবার্তা এসেছে। জনে জনে উত্তরও পাঠিয়েছে সে। শুধু সায়কই কিছু বলেনি। সন্ধ্যাবেলায় কেক নিয়ে রজতদা এসে হাজির। তার আফিস কলিগ তবে তার থেকে একটু সিনিয়র। একটু আমুদে গায়েপড়া লোক বটে তবে মানুষটি বেশ। তার একটি মেয়ে আছে, বউটি মারা গেছে বছর তিনেক আগে, রোড অ্যাক্সিডেন্টে। অনুমিতা একবার ভেবেছিল রজতদাকে ফিরিয়ে দেয় কিন্তু সেটা অশোভন হতো। তবে আটটার দিকে ফের কলিং বেল শুনে বিরক্ত হয় অনুমিতা, আবার কে এলো? কিন্তু দরজা খুলে সায়ককে দেখে সেও জোর চমকেছে। শেষ পর্যন্ত আজই জানাতে পারবে সে কথাগুলো।
সায়ক এসেই সেই যে ঘরে ঢুকেছে আর বেরোয়নি। রজত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে যায়। তারপর সে এককাপ কফি নিয়ে সায়কের কাছে যায়, তাকে কথাটা বলার জন্য। সে সায়ককে ডেকে বলে, “শোনো না, একটা কথা…”
সায়ক তার কথাকে শেষ হতে দেয় না, সে প্রশ্ন করে, “এইসব আর কতদিন চলবে অনু?”
প্রশ্নটা শুনে অনুমিতা থমকায় কিছুটা, সেও প্রশ্ন করে, “কী সব?”
সায়ক বলে, “এই তোমার পরকীয়া, তোমার প্রেমপর্ব ওই রজত বোস লোকটার সাথে। আর কদ্দিন?”
একটু থেমে সায়ক আবার বলে, “আজ হঠাৎ এসে খুব মুশকিলে ফেললাম না তোমাদের? কবাব মে হাড্ডি হতে চাইনি কিন্তু আমার ভাগ্য…”
অনুমিতার মুখের কথাগুলো গলার মধ্যে আটকে থেকে যায়। দুটো অদৃশ্য হাত যেন তার গলা টিপে ধরেছে, ঘরের মধ্যে বাতাস কি ফুরিয়ে আসছে? তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে অনুমিতা বলে, “তুমি যা বলছ সেটা কি তুমি বিশ্বাসও করো?”
সায়ক বলল, “বিশ্বাস না করলে আর বলছি কেনো, আমি অনেকদিন ধরেই দেখছি ব্যাপারটা, আর আজকে তো… আমি সবটা বুঝে গেছি অনু, তুমি ধরা পড়ে গেছ।”
অনুমিতা এবার বলল, “বেশ সবটা নিজেই যখন বুঝে গেলে তখন ভালোই হলো। তবে আমি তোমার রাস্তাটাও পরিষ্কার করে দিলাম, কি বলো? তোমার আর রুমির সাথে থাকতে কোনো বাধা রইল না।”
এই বলেই অনুমিতা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল এবং সেদিন গিয়ে উঠল তার মাসির বাড়ি। তারপর আর সে সায়কের সাথে কথা বলেনি শুধু মেসেজ করে তার না ফেরা আর ডিভোর্সের কথা জানিয়েছিল।
আচ্ছা, এভাবেই কী সমস্ত টা ভাঙে? তাসের ঘরের মতো একঝলক হওয়াতে। এই ভাঙন নামক সহজ সমীকরণের জটিল সমাধান কোথায়? এর সমাধান কি আদতেও জটিল?
(ক্রমশ)
পড়তে পড়তে চরিত্রের মধ্যে হারিয়ে গেলাম।
ধন্যবাদ।