Recent Post

আরও একবার(৩য় পর্ব): জিৎ সরকার

আরও একবার(৩য় পর্ব): জিৎ সরকার

(আগের পর্বটি পরতে এখানে ক্লিক করুন)

ওদিকে তখন অনুমিতার মনেও কিছু দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়েছে। সে সবটুকু বোঝার চেষ্টা করে, কিন্তু সবটুকু কী বুঝতে পারে? সে টের পায় তার সামনে আসলেই সায়কের ব্যবহারে কিছু পরিবর্তন ঘটে। সায়ক তার সামনে আসলে কেমন যেন আড়ষ্ট আর সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে, যেন তার কোনো খুব গোপন কথা এই বুঝি অনুমিতা জেনে ফেলল, সে পালাতে পারলে বাঁচে। অথচ এই সায়কই দূর থেকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে তার দিকে, কখনো সোজাসুজি কখনো বা আড়চোখে, অনুমিতা অনেকবার লক্ষ্য করেছে। অনুমিতার স্বভাবেও কিছু বদল ঘটেছে, সে বাইরে ছদ্ম গাম্ভীর্যের একটা মুখোশ টেনে রাখে তাই তার সাথে সহজে মেশা গেলেও সহজে লঘু হওয়া যায় না। কিন্তু সায়কের ক্ষেত্রে এর একটা ব্যতিক্রম ঘটে গেছে। সায়কের সামনে আসলেই তার এই মুখোশটা যেন ছিঁড়ে পড়তে চায়, সায়কের আড়ষ্ট সন্ত্রস্ত  ভাবটা সে উপভোগ করে, প্রশ্রয় দিতে চায় যেন। একটা চোরা টান সে অনুভব করছে সায়কের জন্য। 

লক্ষীপুজোর দিন সায়কদের বাড়িতে সবার নিমন্ত্রণ। আভা আর অনুমিতা একটু আগেই এসেছে সায়কের মা কে সাহায্য করার জন্য, পুজোর জোগাড় শেষ হলে অনুমিতা নিজেই সায়কদের বাড়িটা ঘুরে দেখছিল, সায়কদের পৈতৃক ভিটে, সায়কের বাবার ঠাকুরদা বানিয়েছিলেন এটি, বেশ বড়ো। সায়কের বাবার ঠাকুরদা ছিলেন খাঁটি ব্যবসায়িক মানুষ, তিনি ব্যবসা করে বেশ দু-পয়সা কামান তার থেকেই এ বাড়ি আর বেশ কিছু জমিজমা করেন।  কিন্তু তার ছেলে অর্থাৎ সায়কের দাদুর ব্যবসায়িক বুদ্ধি সেরকম পরিপক্ক ছিল না,  তার উপর তার নতুন ব্যবসার ফন্দি এর সাথে পাল্লা দিতে তারা একপুরুষের মধ্যেই বড়োলোক থেকে স্ট্রেট সর্বশান্ত। জমিজমা সবই গেছে থাকার মধ্যে শুধুই এই বাড়িটা।

আরও একবার(৩য় পর্ব): জিৎ সরকার

সায়কের ঘরের সামনে গিয়ে একমুহূর্ত দাঁড়াল অনুমিতা। তারপর কী যেন ভেবে ঢুকল ঘরে।  ঘরে সমস্ত জিনিস পরিপাটি করে গোছানো, রুচির ছাপ স্পষ্ট। সায়কের বইপত্র দেখছিল অনুমিতা, টেবিলের উপর একটা আঁকার খাতা চোখে পড়ল তার। খাতাটা হাতে নিয়ে সে পাতা উল্টোতে লাগল বেশিরভাগই পোট্রেট, কিছু ল্যান্ডস্কেপ।  উল্টোতে উল্টোতে একটা পোট্রেটে এসে সে আটকে যায়, চিত্রকরের নিপুণ হাতে আঁকা স্পষ্ট একটি মুখাবয়ব,  তার মুখাবয়ব। অনুমিতা কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ছবিটার দিকে। তারপর পেছনে একটা শব্দ হতেই খাতা রেখে ফিরে চাইল। সায়ক ঘরে ঢুকে বলল, “তুমি এখানে, ওদিকে মা তোমায় খুঁজছেন। সবাই চলেও এসেছে, চলো”। 

অনুমিতাও  “হুঁ, চলো” বলে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে বলল  “আচ্ছা,  আমাকে তোমার কেমন লাগে সায়কদা?”

সায়ক কেমন যেন থতমত খেয়ে বলল   “কেন, ভালোই তো লাগে।”

এবার অনুমিতা পূর্ণদৃষ্টিতে সায়কের মুখের দিকে চেয়ে বলল, “শুধুই ভালো লাগে? আর কিচ্ছু না?”

বলেই ঘর থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।  একা ঘরে সায়ক বোকারমত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ যেন কি একটা রহস্য বুঝি বুঝি করেও বুঝতে পারছে না সে।

সব রহস্য সবার দ্বারা ভেদ হয় না, এটা যেমন হল না সায়কের দ্বারা। আসলে মেয়েদের চরিত্র সর্ম্পকে সায়কের জ্ঞান ওই অ-এ অজগর আসছে তেড়ে পর্যন্ত। সে স্বপ্নেও ভাবেনি অনুমিতা তার মনের গোপন কথাটি জেনে ফেলেছে। এদিকে বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে। সায়ক আর এম্ এস্ সির দিকে এগোয়নি।  বরং রান্নাবান্না আর হোটেলিং এর উপর একটা কোর্স করছিল। রান্না জিনিসটা সায়ক পেয়েছিল তার মার কাছ থেকে। গান আর আঁকার মতোই এ কাজটাতেও তার ধৈর্য ছিল অসীম। এমত অবস্থার অনুমিতাই সায়ককে  

প্রথম অফিসিয়ালি প্রপোজটা করে, আভার বুদ্ধিতে। আভা সায়ককে ভালো করে চেনে, ও জানত এসব ব্যাপারে সায়ক একদম আনাড়ি ওর দ্বারা আর যাইহোক প্রেম নিবেদন হবে না। তাই আভাই অনুমিতাকে বুদ্ধিটা দেয়, অনুমিতা নিয়েও নেয়। অনুমিতার মতো লাজুক আর গম্ভীর মেয়ের পক্ষে এটা একটু অস্বাভাবিক বটে কিন্তু প্রেমে পড়ে লজ্জা আর গাম্ভীর্য ত্যাগ এ জগতে নতুন নয়। তবে এতটার জন্য সায়ক প্রস্তুত ছিল না। অনুমিতার মুখে প্রেমের প্রস্তাব শুনে কেমন হকচকিয়ে যায় সায়ক।  হার্টটা যেন আরবি ঘোড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছিল সেই মুহূর্তে, এই বুঝি বুকের চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসবে, কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো তোতলাচ্ছিল সে।  হ্যাঁ বলতে গিয়ে কতবার হোঁচট খেল কে জানে। বাকপটু সায়কের একটা লাজুক মেয়ের সামনে পড়ে এই ল্যাজেগোবরে হওয়ার ঘটনা শুনে অম্লান আর শুভ্রদারা খুব মজা পেয়েছিল।

পেরিয়ে গেছে আরও কিছুটা সায়ক।  সায়ক আর অনুমিতা ঘনিষ্ঠতা আরও অনেকটা বেড়েছে। বাড়ির লোকেও জেনেছে অল্পবিস্তর। অনুমিতার মাষ্টার্স-এর শেষে যখন বিয়ের প্রস্তাব উঠল তখনও দুতরফের বাড়ি থেকে আপত্তি উঠেছিল।  আপত্তির কারনটা অবশ্যই দুতরফেরই প্রায় এক। সায়কের বাবার মতে সায়ক যেহেতু আর্থিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত নয় তাই তার এই বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আরেকটু ভাবা উচিত। আর অনুমিতার বাবা চান বড় সরকারি চাকুরে জামাই কারন তাদের বাড়ির জামাইরা সবাই নাকি বড়ো চাকুরে, আর সায়ক চালায় একটা রেস্তরাঁ, অদ্ভুত যুক্তি সন্দেহ নেই তবুও তো যুক্তি। তবে সায়ক আর অনুমিতার জেদের সামনে এ সব ধোপে টেকেনি।

এক অঘ্রানে সায়ক আর অনুমিতার চার হাত এক হয়ে যায়। তারপরের দুটো বছর কেটেছে স্বপ্নের মতো। আশা ভালোবাসার নব প্রতিশ্রুতিতে অঙ্গীকার বদ্ধ তাদের নতুন জীবনে এ দুটো বছর যেন তীব্র খরস্রোতা নদীর মতোই বয়ে গেল। তারপর? তারপর সব সব প্রতিশ্রুতি যেমন নিজের নিয়মে ভাঙে, তাদের গুলোও ভাঙল।

মানুষ হিসেবে অনুমিতা পাল্টায়নি, সময়ের সাথে সাথে পাল্টানো তার স্বভাবে ছিল না।  সায়ক এ ক-বছরে বদলেছে অনেকখানি।  তার ভিতরের ক্যারিয়াস্টিক মানুষটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তার ব্যবসা বেড়েছে অনেকখানি, রেস্তোরাঁর আউটলেট রাজ্যের সর্বত্র ছড়াচ্ছে। সায়ক এখন ফোন না হয় ল্যাপটপ না হয় তার পার্টনার রুমির সাথে নতুন আইডিয়া খুঁজতে ব্যস্ত। যে বা যারা তাকে কথা শোনাত তাদের সক্কলের মুখ সে বন্ধ করে দিয়েছে। মুখবন্ধ অনুমিতারও। অনুমিতাও একটা চাকরি করে নিয়েছে। কোম্পানির বাঁধা সময়ের কাজ তার। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে সে যখন খাবার নিয়ে সায়কের জন্য অপেক্ষা করে করে ঘুমিয়ে পড়ে আর ঘুম থেকে উঠে যখন দেখে সায়ক ফেরেনি তখন বড্ড একা লাগে তার। কিংবা সন্ধ্যাবেলায় চা কাপটা হাতে সে যখন একা বারান্দায় বসে বা কাজ করতে করতে যদি হঠাৎ মাথা ধরে তখন একটা হাতের বড়ো অভাব বোধ করে অনুমিতা। যে সায়কের হাত ভালোবেসে সে ধরেছিল সেই সায়ক নিজেকে ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে চলে গেছে। মানুষের এই স্বভাব, ছুটতে জানে কিন্তু কোথায় থামতে হবে সেটা সে না। এই কি তবে অনুমিতার হারিয়ে যাওয়ার শুরু? এই শুরু তবে,  ভাঙনের?

(ক্রমশ)

Author

  • Barun@Mukherjee

    নবতরু ই-পত্রিকার সম্পাদক বরুণ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৮৪ সালে। বীরভূম জেলার নানুর থানার শ্রীকৃষ্ণপুরের গ্রামের বাড়িতেই বড়ো হয়ে ওঠেন। আবাসিক ছাত্র হিসাবে বিদ্যালয় জীবন অতিবাহিত করেন বিশ্বভারতীর পাঠভবন ও উত্তর শিক্ষা সদনে। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ বরুণ মুখোপাধ্যায় বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত আছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ভালোবাসেন লেখালেখি করতে। এছাড়াও সাংস্কৃতিক চর্চা ও সৃজনশীল কাজকর্মের মধ্যে নিজেকে সর্বদা যুক্ত রাখেন। নতুন ছেলেমেয়েদের মধ্যে সাহিত্য সৃষ্টির উন্মেষ ঘটানোর জন্যই দায়িত্ব নিয়েছেন নবতরু ই-পত্রিকা সম্পাদনার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার (১/১২ পর্ব)
গদ্য- সাহিত্য গল্প ধারাবাহিক গল্প

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার

    গাড়িটা যখন বড়ো গেটের সামনে এসে দাঁড়াল তখন শেষ বিকেলের সূর্য পশ্চিমাকাশে রক্তাভা ছড়িয়ে সেদিনকার মতো সন্ধ্যেকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল
    গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

    শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল

      আমার শৈশব ভাড়াবাড়িতে। তাই গরমের ছুটিতে কাকু, জেঠুদের বাড়ি টানা একমাস ছুটি কাটাতে যেতাম। মামাবাড়িও যেতাম। ছেলেবেলার গরমকাল জুড়ে বেশ কিছু মজার স্মৃতি আছে

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      চাদিফাঁটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ
      গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

      চাঁদিফাটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ

        মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার সেইসব দিন, প্রচন্ড গরম থেকে স্বস্থির আরাম

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন