(১/১২ পর্ব)

(১/১২ পর্ব)
গাড়িটা যখন বড়ো গেটের সামনে এসে দাঁড়াল তখন শেষ বিকেলের সূর্য পশ্চিমাকাশে রক্তাভা ছড়িয়ে সেদিনকার মতো সন্ধ্যেকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পিছনে কাঁচা রাস্তা বরাবর যতদূর চোখ যায় হালকা উত্তুরে হাওয়া সাথে উড়ন্ত ধুলো মিশে একটা আবছা ধোঁয়াটে ক্যানভাস তৈরি করেছে। এই ধোঁয়াটে ক্যানভাসে যতদূর চোখ যায় তাতে রাস্তার দুপাশে ঝোপঝাড় আর কয়েকটা বৃক্ষ জাতীয় গাছ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। গাড়ির সিটবেল্টটা খুলে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল তনয়া। ডান কানের ওপর থেকে চুল সরিয়ে সাদা রঙের ইয়ারবাড খুলে গাড়ির ড্যাশবোর্ডে রাখা চার্জিং কেসের মধ্যে ভরে রাখল। তারপর গাড়ির গেট খুলে মাটিতে পা দিল। সামনে লোহার বড়ো গেটটা এখন বন্ধ কিংবা বলা ভালো ভেজিয়ে রাখা। দীর্ঘদিনের ঝড় জল রোদের সাহচর্য পেয়ে গেটটির সর্বাঙ্গে তাদের নিজস্ব ছাপ রেখে গেছে। একটা নাম না জানা আরোহী লতা গেটের একটা অংশকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে ঠিক সহোদরের মতো। তনয়া জানে বাড়ির ভেতরে লোক আছে। অন্তত একজন লোক তো আছেই। এখান থেকে জোরে জোরে ডাকলে বা গাড়ির হর্ণ বাজালে সেই মানুষটি এসে দরজাটা খুলেও দেবে। কিন্তু এই মুহূর্তে কাউকে ডাকতে ঠিক ইচ্ছে হচ্ছে না তনয়ার। খুব ভালো করে গেটটার ওপারে যতটুকু দেখা যায় সেটাকে লক্ষ্য করল তনয়া। গেটের ওপারে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা বেশ বড়ো বাগান। তাতে বড়ো গাছই মূলত আছে, কিন্তু দীর্ঘদিনের অযত্নের ফলে গাছের সাথে আগাছারাও বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে সেখানে। এই বাগানের মধ্যে দিয়ে একটা চওড়া রাস্তা চলে গেছে সিমেন্ট বাঁধানো গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত। গাড়ি বারান্দার ওপার থেকে শুরু হয়েছে মূল বাড়ি। তনয়া দু’পা এগিয়ে একটা ঠেলা দিল গেটটায়। একটা দীর্ঘ ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল শতাব্দী প্রাচীন দরজাটা। তনয়া ফিরে এসে গাড়িতে স্টার্ট দিল তারপর চালিয়ে দিল সামনের দিকে। বাগানের পথটার মধ্যে দিয়ে তনয়া গাড়িটা নিয়ে যখন খুব আস্তে আস্তে গাড়ি বারান্দার দিকে এগোচ্ছে চারিপাশের প্রকৃতিরকে দেখতে দেখতে তখন আরেক দফা উত্তুরে হাওয়া বাগানের গাছ গুলোর মাথায় মৃদু একটা আন্দোলনের সৃষ্টি করল। হালকা একটু শিউরে উঠল তনয়া। একটা অদ্ভুত ভাব তার মনের মধ্যে খেলে গেল। চারপাশের প্রকৃতিও কি স্বাগত জানাচ্ছে তাকে? না কি সর্তক করে দিচ্ছে অবেলার এই আগন্তুক কে—কোনও অজানা অদেখা বিপদের থেকে। উঠোনের ঠিক মাঝখানে ফাঁকা তুলসী বেদির পাশে দাঁড়িয়ে একমনে তিনমহলা বাড়িটিকে লক্ষ্য করছিল তনয়া। না, লক্ষ্য করার মতো হয় তো তেমন বিশেষ কিছুই নেই, ঠিক আর পাঁচটা পুরোনো বনেদি বাড়ির যেমন হয় এটাও তেমন, কিন্তু সেই মেয়েবেলা থেকেই প্রাচীনত্বের বর্ণ, গন্ধ খুব ভালো লাগে তনয়ার। তাই তো তার প্রিয় বিষয় ইতিহাস। বাড়ির সকলের আপত্তি সত্ত্বেও সেই ওই বিষয় নিয়েই স্নাতকোত্তর পড়েছে। ফিল্ড ওয়ার্কের কিছু অভিজ্ঞতায় এধরনের বাড়ি সে আগেও দেখেছে, কিন্তু এই বাড়িটার কথা আর পাঁচটা বাড়ির থেকে আলাদা। এটা তার পৈতৃক ভিটে, তার শেকড়। (ক্রমশ)