সন্ধ্যায় ঠাকুরকে উঠোনে নামিয়ে বরণ করে সকলের মুখে একটু করে সিদ্ধি দিয়ে মা দুর্গার কাঠামোসহ মূর্তিটি তুলে কালীসায়রে বাদ্যসহকারে বিসর্জন দেওয়া হয়। ওইসময় বাজিও পোড়ানো হয়। দীর্ঘকাল যাবৎ আমাদের (এবং সুরুলের অন্যান্য প্রতিমাও) কাঁধে করে বাড়ি থেকে কালীসায়র অবধি নিয়ে যাওয়া হত। আমাদের বাড়ির প্রতিমা নিয়ে যেত সুরুলের বাউরীপাড়ার ছেলেরা। এরা বংশানুক্রমে এই কাজটি করে আসছে। তবে বর্তমানে ঠাকুর দশমীর দিন বিসর্জন ও একাদশীর দিন কাঠামোটি কালিসায়র থেকে আনার জন্য একটি চার চাকার ট্রলি তৈরী করানো হয়েছে কয়েক বছর আগে। এতে করে পরিশ্রম কম হয়। বিসর্জনের জন্য আগে হ্যাচকের আলো ও কাপড়ের তৈরি মশাল ব্যবহার করা হত। বর্তমানে হ্যালোজেন আলো ব্যবহৃত হয়। বিসর্জনের পর কালীসায়রের কালীমন্দিরে গিয়ে সকলে প্রণাম করে ও নৃত্য করে পূজামণ্ডপে ফেরা হয়। প্রসঙ্গত, পুজোর এক এক সময়ের বাজনা এক একরকমের হয়। আরতি, বলিদান এবং বিসর্জনের বাজনা ভিন্ন ভিন্ন হয়। কয়েকটি গান শুধুমাত্র বিসর্জনের দিনেই সানাইবাদক বাজিয়ে থাকেন। বিসর্জনের পর বাড়ি ফেরার পথে পরিবারের কেউ একজন (সাধারনত বয়স্ক সদস্য) সেই গানগুলি গেয়ে ধুয়ো ধরিয়ে দেন এবং বাকিরাও একইসঙ্গে সেই গান ও বাজনা সহযোগে নৃত্য করতে করতে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। এইরকমই একটি গান হলো, “ও মা দিগম্বরী নাচো গো শ্যামা রণমাঝে।” ছোটবেলায় বাবাকে এবং পরবর্তীকালে বিশুদাকে দেখেছি ওই ধুয়ো ধরিয়ে দেওয়ার কাজটি করতে। এইভাবে সবাই নৃত্য গীত সহকারে বাড়ি ফিরে প্রতিমাশূন্য মন্দিরে প্রণাম জানান। ঢুলেদাররাও শেষবারের মতো একবার বাজনা বাজিয়ে মা এর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানায়। তারপর সকলে স্নান করে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ঠাকুরবাড়িতে আসে এবং উত্তরপাড়ায় গিয়ে গুরুবাড়িতে প্রণাম করে ফিরে আসে। এরপর ঠাকুরবাড়িতে পুরুষ ও মহিলাদের বয়ঃক্রম অনুযায়ী দাঁড়িয়ে প্রণাম ও কোলাকুলি করে মিষ্টিমুখ করে বিজয়া সারা হয়। যারা বয়স্ক বা অসুস্থ, ঠাকুরবাড়িতে আসতে পারেন না, তাদেরকে সেই বিজয়ার দিন বা পরের দিন তার বাড়ি গিয়ে প্রণাম ও আশীর্বাদ নেওয়ার রীতি বা প্রথা এখনো চালু আছে। তবে দশমীর দিন বিসর্জনের পরে আর উত্তরপাড়ায় গুরুবাড়িতে প্রণাম করতে যাওয়া হয় না। ঠাকুরের কাঠামোটি একাদশীর দিন সকালবেলায় কালীসায়র থেকে তুলে এনে ঠাকুরবাড়ির চাতালে রাখা হয়। এরপরে শুরু হয় আবার একবছরের প্রতীক্ষা।

বয়সজনিত কারণে শরীর ও মনের কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে ক্রমাগত। জানিনা আর কতদিন দুর্গাপুজো করার এই গুরুদায়িত্ব বহন করতে পারব। মাঝে মাঝে মনে হয় পরবর্তী প্রজন্ম কি পারবে সবকিছু এমন করে ধরে রাখতে! তবে তারই মধ্যে দেখতে পাই আমার ভাইপোরা ধীরে ধীরে পুজোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছে। আমার এক নাতি (জগন্নাথ মুখার্জীর পৌত্র) নিজে হাতে ভারি সুন্দর মাটির প্রতিমা গড়তে শিখেছে। যেমন আমরা সেই ছেলেবেলায় গড়তাম। এমনি করেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলে ধারা। বহমানতাই জীবন।
(সমাপ্ত)