Recent Post

আমার স্মৃতিতে বাড়ির দুর্গাপূজা(৯ম পর্ব): রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়

(আগের পর্বটি পড়ুন)

পরদিন অষ্টমীপূজার শুরুতে অষ্টদলপদ্ম এঁকে ও পতাকা লাগিয়ে পূজা শুরু করা হয়।  প্রথমে মায়ের ঘুম ভাঙিয়ে বিল্বকাষ্ঠ  ও গুঁড়ো আতপচাল (স্বস্তিক ) সামান্য জলে গুলে গরম করে মায়ের দন্তমার্জনা করা হয়। এরপর ষোড়শপচারে মায়ের পুজো হয়। অষ্টদলপদ্মের প্রত্যেক অধিষ্ঠাত্রী দেবী, ভৈরব, ক্ষেত্রপাল, বটুকগণ, ৬৪যোগিনী প্রভৃতি সকলকে এবং করে পঞ্চোপচারে পুজো করা হয়। প্রসঙ্গত, আমাদের দুর্গাপূজায় সন্ধিপুজোতে মাসকলাই বলিদান হয়ে থাকে। বাবার মুখে শুনেছি আগে আমাদের বলিদান প্রথা ছিল কিন্তু কোনো এক পূর্বপুরুষ একবার আত্মবলিদান করায় তারপর থেকে ছাগবলির প্রথা উঠে যায়। সন্ধিপুজোয় চামুন্ডা রূপে মায়ের পুজো হয় এবং ১০৮টি পদ্ম অষ্টদলপদ্মে মাকে নিবেদন করা হয়। ওইদিন বাইরের বহু মানুষও পুজো দিয়ে থাকেন।

নবমীর দিন ঋতুমতী হয়নি এরকম কুমারীর বয়স অনুযায়ী নামকরণ করে বিশেষ আসনে বসিয়ে এবং তাকে পছন্দমতো সাজিয়ে দেবী মহামায়ার প্রতীক জ্ঞানে পূজা করা হয়। বেলুড়মঠে অষ্টমীর দিন কুমারীপূজার প্রচলন আছে কিন্তু আমাদের বাড়িতে নবমীপূজার দিন এই পূজা হয়। এক থেকে ষোলো বৎসর বয়সী কেউ কুমারী হতে পারে এবং বয়স অনুযায়ী কুমারীর নামকরণ করা হয়ে থাকে। কুমারী পূজার পর নবমীর দিন হোম করা হয়। উল্লেখযোগ্য হল, করবীকোরক অর্থাৎ করবী পুষ্পের ২৮টি কুঁড়ি নারায়ণের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। এরপর নিয়মিত চন্ডীপাঠ, ভোগ নিবেদন করে দিনের পূজা শেষ হয়। সন্ধ্যায় আরাত্রিক এবং তারপর শীতল দিয়ে মাকে শয়ন দেওয়া হয়। নবমীর দিনেই বিকেলে ট্রাস্টিদের অর্থাৎ বাড়ির সদস্যদের বার্ষিক মিটিং হয় এবং পুজোর খরচ ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হয়।  এছাড়া লালদা (ড. সুকুমার মুখোপাধ্যায়) ওইদিন বিনামূল্যে গ্রামের অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা করেন যা বহু বহু বছর ধরে চলে আসছে।

সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিন দিনই সন্ধ্যায় একবার করে আরতি হয়। এছাড়া সন্ধিপুজোর সময় ও দশমীর দিন বিসর্জনের পূর্বে একবার করে আরতি হয়। ওই দুটি আরতি আমি করে থাকি। আর সন্ধ্যারতি পূর্বে নীলদা করত এখন নীলদার কনিষ্ঠ পুত্র অভিজিৎ ওরফে বুবাই করে থাকে।

Nabataru-e-Patrika-June-2022-1.jpeg

               আরতির জন্য সর্বপ্রথমে ষোলো প্রদীপ, তারপরে পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে আরতি হয়। এরপরে কর্পূর (তেজের প্রতীক), শঙ্খ (অপ অর্থাৎ জলের প্রতীক), বস্ত্র (ব্যোম এর প্রতীক), দর্পণ (ক্ষিতির প্রতীক) পুষ্প এবং চামর (ব্যোম এর প্রতীক) এইগুলি দিয়ে আরতি করা হয়। সেই অর্থে দেখতে গেলে দুর্গাপূজা হলো সমগ্র প্রকৃতির পূজা। প্রকৃতির সব উপাদানই এই পুজোয় বর্তমান। আরেক মতে দুর্গাপ্রতিমার মধ্যে বিরাজমান সমগ্র বাস্তুতন্ত্র। যেমন সর্পের আহার ইঁদুর, ময়ূরের আহার সর্প, সিংহের আহার অন্যান্য পশুপাখি ইত্যাদি। আবার অন্যমতে, আরতির এক একটি ধাপে লুকিয়ে আছে মমতা, স্নেহ। মা দুর্গা বাপের বাড়ি এসেছেন। তাঁর অঙ্গে কোনো ধুলোবালি নেই তো, তাই প্রদীপ জ্বালিয়ে দেখে নেওয়া। শঙ্খের জল দিয়ে ধুইয়ে দেওয়া, তারপরে বস্ত্র দিয়ে মুছিয়ে দেওয়া। এরপরে দর্পণ দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া আর পুষ্প দিয়ে সাজিয়ে চামর দিয়ে বাতাস করা। সবকিছুর মধ্যেই যেন মমতা মাখানো।

         সন্ধ্যারতির সময় বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরাও কাঁসর ঘন্টা ও চামর সহযোগে যোগদান করে। আগে বাতাস করার জন্যে দুটি বড়ো বড়ো পাখাও ছিল কিন্তু এখন নষ্ট হয়ে গেছে। সন্ধ্যারতি দেখার জন্য বাইরের বহু মানুষেরও ভীড় হয়।  

সন্ধ্যারতির পর বাড়ির সবাই ঢোলের বাদ্যের সঙ্গে নৃত্যপূর্বক আমোদ করে থাকে। এই প্রথা বহু পুরোনো। আমি আমার বাবাকেও ঢোলের বাদ্যের সঙ্গে নৃত্য করতে দেখেছি। তখন তিনি সত্তরোর্ধ। এই আনন্দে মেতে ওঠে বাড়ির কঁচিকাঁচারাও। ঢুলেদাররাও বাড়ির সকলের মনোরঞ্জনের জন্য নতুন নতুন বাদ্য শিখে আসে প্রতিবছর। সন্ধ্যারতির শেষদিন অর্থাৎ নবমীর দিন সকলে তাদের কিছু বখশিস দিয়ে পুরস্কৃত করে থাকে। কোনও কোনও বছর বাড়ির ছেলেমেয়েরা মিলে আরতির পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

(ক্রমশ)

Author

  • রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়

    বর্ষীয়ান লেখক রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৫৫ সালে বীরভূমের সুরুল গ্রামে। তিনি তাঁর তেরো ভাইবোনের মধ্যে একাদশতম। গ্রামের সুরুল প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তারপরে বোলপুর উচ্চবিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করেন। এরপরে বিশ্বভারতীর পল্লীশিক্ষাভবনে যোগ দেন কৃষিবিদ্যায় স্নাতকস্তরের পড়াশোনার জন্য। সেইসময় পশ্চিমবঙ্গে কৃষিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পড়াশোনার সুবিধা ছিল না। কিন্তু নিজের মেধার যোগ্যতায় বৃত্তি-প্রাপ্ত হয়ে পাড়ি দেন উত্তরপ্রদেশের গোবিন্দ বল্লভ পান্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে তিনি স্নাতকোত্তর স্তরে কীটবিদ্যা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন ও সর্বশ্রেষ্ঠ থিসিস (best master's thesis) পুরস্কার প্রাপ্ত হন। স্নাতকোত্তর পড়ার সময়েই চাকরির সুযোগ আসে ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়াতে (যা বর্তমানে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত)। পড়া শেষ করেই সেখানে যোগদান করেন অফিসার হিসেবে। কৃষিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর হবার সুবাদে সেসময়ে গ্রামীণ চাষীদের ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সুবিধা ও অসুবিধা দেখাশোনার কাজই ছিল মুখ্য। কাজের সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় কাটাতে হয়েছে তাঁকে। শেষমেশ বাবা মায়ের টানে এসে থিতু হন সেই বোলপুরেই। বীরভূমের বিভিন্ন শাখায় কেটেছে বাকি কর্মজীবন। ২০১৬ সালে বীরভূমের আমোদপুর শাখা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনে ভারতবর্ষের বহু স্থানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। অবসর জীবনে বইপত্র পড়া, বাগান করা ও পূজা অর্চনাতে দিন কাটে। বিগত ১৫ বছর যাবৎ সুপ্রাচীন পারিবারিক দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করে আসছেন। পাশাপাশি সুবিশাল পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন তিনি। লেখক শ্রীমুখোপাধ্যায়ের কথায়, "প্রথাগতভাবে লেখালেখি করা হয়ে ওঠেনি কখনো। এখন অবসর জীবনে এসে একমাত্র মেয়ের আবদারে কলম ধরেছি।"

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল
গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল

    আমার শৈশব ভাড়াবাড়িতে। তাই গরমের ছুটিতে কাকু, জেঠুদের বাড়ি টানা একমাস ছুটি কাটাতে যেতাম। মামাবাড়িও যেতাম। ছেলেবেলার গরমকাল জুড়ে বেশ কিছু মজার স্মৃতি আছে

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    চাদিফাঁটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ
    গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

    চাঁদিফাটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ

      মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার সেইসব দিন, প্রচন্ড গরম থেকে স্বস্থির আরাম

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      শৈশবের গরমকাল: মধুরিমা বন্দ্যোপাধ্যায়
      গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

      শৈশবের গরমকাল: মধুরিমা বন্দ্যোপাধ্যায়

        শীত বুড়ির চাদর পেড়িয়ে যখন গ্রীষ্মকাল আসে দাবদাহ যেন ভৈরব সন্ন‍্যাসীর মতন তাড়া করে। আমাদের ছোটবেলায় মুঠোফোন অনেক দূরের ব‍্যাপার লোডশেডিং এর পাড়ায় কার্টুন দেখাও ছিল শক্ত কাজ।

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন