ষষ্ঠীর সন্ধ্যাতেই ঢুলেদাররা এসে হাজির হয়। এই গ্রামের সব পুজোতেই ঢোল বাজে, ঢাক নয়। আমাদের বাড়ির ঢুলেদাররা বংশপরম্পরায় বাজিয়ে আসছে। মোট চারজন ঢুলেদার, একজন সানাইবাদক এবং একজন কাঁসরবাদক। তারা এসেই প্রথমে মন্দিরে প্রতিমার উদ্দেশ্যে ঢোলবাজিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পুজোর চারদিন তাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘর নির্ধারিত থাকে। সেখানেই তারা রান্না খাওয়া করে ও বিশ্রাম করে। পূজা চলাকালীন প্রতিদিন ভোরে সানাইয়ে নহবতের সুরে তারা দিনের সূচনা করে। ওই সময় ঢোল বাজাতো থসাই মুচি ও তার জামাই। পরে বাবা যখন ম্যানেজার হলেন তখন থেকে বর্তমানে যারা বাজায় তারা তিন-চার পুরুষ ধরে বাজাচ্ছে। এরা আসে বীরভূমের খয়েরবুনি গ্রাম থেকে। বর্তমানে যে ঠাকুরবাড়ির উত্তরদিকের গেট তার পাশেই তালপাতার ছাউনি দিয়ে এদের জন্য অস্থায়ী আস্তানা তৈরি হত। এখন ঠাকুরের ভোগের ঘরের পাশে এদের পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছে। বর্তমান প্রজন্মে যারা বাজায়, তারা চারপুরুষ ধরে বাজাচ্ছে। মামা, নারান, শিবু, কাঙাল ও কাঙালের ছেলে। এরা বাদ্যকর হিসেবে অতি উচ্চমানের।

ছোটবেলায় দেখেছি লালদাদের ঘরের উঠোনে একটি ভোগের ঘর ছিল। ওখানেই জগদীশদা বল্লভপুর থেকে এসে ভোগ রান্না করত। বাবাদের কাছে শুনেছিলাম তার আগে নিত্যকাকার মা ভোগ রান্না করতেন। ঠাকুরের অন্নভোগ বরাবর দেওয়া হয়। বিশেষত্ব বলতে পাঁচ-সাত রকম ভাজা, ভাত, ডাল, তরকারি, চাটনি, পায়েস ও পান। সপ্তমীর ভোগের সঙ্গে কচুর শাক দেওয়া হয়। অষ্টমীর দিন খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয়। সন্ধিপূজায় লুচি, সুজি, নাড়ু, মন্ডা ইত্যাদি ভোগরূপে দেওয়া হয়। নবমীতে অন্নভোগ, দশমীতে চিঁড়াভোগ। বর্তমানে যে ভোগ রাঁধে তার নাম রূপক, প্রায়৩০-৩৫ বছর ধরে রাঁধছে। এখন তার সঙ্গে একজন সহকারীও থাকে। তার নাম শিবে। আমাদের বাড়ির আরও একটি বৈশিষ্ট এই যে, পুজোর সব কাজ অর্থাৎ ফুল সংগ্রহ, প্রসাদের ফল বনানো, মালা গাঁথা, নৈবেদ্য সাজানো, ঠাকুর বাড়ি পরিষ্কার রাখা, আরতির সময় ধুপ দীপ, ধুনো জ্বালিয়ে রাখা প্রভৃতি সব কাজ বাড়ির সবাই মিলেই করে থাকেন। আগে শুধু ছেলেরাই এই কাজে অংশগ্রহণ করত কিন্তু কালের প্রবাহে সেই সংকীর্ণতা ঘুচে গেছে। আবার কিছু কিছু কাজ দেখতাম এক একজন প্রতি বছর দায়িত্ব সহকারে করে। যেমন নীলদা ঠাকুরের গয়না পরাত, জগাদা সন্ধিপুজোর ১০৮ টি পদ্ম সুন্দর করে পাপড়ি খুলে খুলে সাজিয়ে দিত। সন্ধ্যারতির সময় ভারি ঘণ্টাটা বাজাত সন্তোষদা। ধুনো যাতে না নিভে যায় সেদিকে খেয়াল রাখত পীতুদা। কলাবউ সাজাত ছোড়দা। এমন আরও কত কি। কত মানুষের ছোট্ট ছোট্ট সহায়তায় সম্পন্ন হতো এই বিরাট কর্মযজ্ঞ।
যখন ছোট ছিলাম তখন বাড়িতে মায়েরা দিদিরা সবাই পুজোর সময় বাড়িতেই ব্যস্ত থাকতেন। কবে থেকে শুরু হয়ে যেত নাড়ু, মুড়কি তৈরি করা। পুজোর ক’দিন ও তাদের ব্যস্ততার শেষ থাকত না। এতগুলি লোকের রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা তাদেরকেই দেখতে হত। পরবর্তীকালে বিশুদা সপ্তমীর দিন আর লালদা নবমীর দিন সবার দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করে। এই ব্যবস্থা বহুদিন চলেছিল। তারপরে আমি আমার দাদা ও অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে কথা বলে স্থির করি যে দশমীর দিনটাও যদি বাকি সবাই মিল একসঙ্গে খাওয়ার ব্যবস্থা হয় তাহলে বাড়ির বউ মেয়েদের আর রান্নাবান্নার জন্য ব্যস্ত হতে হয় না। আর অষ্টমীর দিন এমনিতেই বেশিরভাগ মানুষ উপবাস করতেন। আমার দাদা (মিহির কুমার) খেতে ও খাওয়াতে যারপরনাই ভালোবাসতেন। তাই এই প্রস্তাবে তাঁর উৎসাহই সবচেয়ে বেশি ছিল। এভাবে বেশ কিছু বছর চলার পরে দাদা স্বর্গগত হন (১৯৯৮ সালে)। দাদা বিশুদা ও লালদার সমবয়সী ও পরম বন্ধু ছিলেন। তাই তিনি চলে যাবার পরে খাওয়ানো দাওয়ানোর ব্যাপারটা উঠে যায়। বর্তমানে ভোগের পরিমান অনেক বাড়ানো হয়েছে। সকলেই প্রতিদিন পুজোর পরে ভোগের প্রসাদ পান।