Recent Post

আমার স্মৃতিতে বাড়ির দুর্গাপূজা(৭ম পর্ব): রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়

(আগের পর্বটি পড়ুন)

ষষ্ঠীর সন্ধ্যাতেই ঢুলেদাররা এসে হাজির হয়। এই গ্রামের সব পুজোতেই ঢোল বাজে, ঢাক নয়। আমাদের বাড়ির ঢুলেদাররা বংশপরম্পরায় বাজিয়ে আসছে। মোট চারজন ঢুলেদার, একজন সানাইবাদক এবং একজন কাঁসরবাদক। তারা এসেই প্রথমে মন্দিরে প্রতিমার উদ্দেশ্যে ঢোলবাজিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পুজোর চারদিন তাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘর নির্ধারিত থাকে। সেখানেই তারা রান্না খাওয়া করে ও বিশ্রাম করে। পূজা চলাকালীন প্রতিদিন ভোরে সানাইয়ে নহবতের সুরে তারা দিনের সূচনা করে। ওই সময় ঢোল বাজাতো থসাই মুচি ও তার জামাই। পরে বাবা যখন ম্যানেজার হলেন তখন থেকে বর্তমানে যারা বাজায় তারা তিন-চার পুরুষ ধরে বাজাচ্ছে। এরা আসে বীরভূমের খয়েরবুনি গ্রাম থেকে। বর্তমানে যে ঠাকুরবাড়ির উত্তরদিকের গেট তার পাশেই তালপাতার ছাউনি দিয়ে এদের জন্য অস্থায়ী আস্তানা তৈরি হত। এখন ঠাকুরের ভোগের ঘরের পাশে এদের পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছে। বর্তমান প্রজন্মে যারা বাজায়, তারা চারপুরুষ ধরে বাজাচ্ছে। মামা, নারান, শিবু, কাঙাল ও কাঙালের ছেলে। এরা বাদ্যকর হিসেবে অতি উচ্চমানের। 

ছোটবেলায় দেখেছি লালদাদের ঘরের উঠোনে একটি ভোগের ঘর ছিল। ওখানেই জগদীশদা বল্লভপুর থেকে এসে ভোগ রান্না করত। বাবাদের কাছে শুনেছিলাম তার আগে নিত্যকাকার মা ভোগ রান্না করতেন। ঠাকুরের অন্নভোগ বরাবর দেওয়া হয়। বিশেষত্ব বলতে পাঁচ-সাত রকম ভাজা, ভাত, ডাল, তরকারি, চাটনি, পায়েস ও পান। সপ্তমীর ভোগের সঙ্গে কচুর শাক দেওয়া হয়। অষ্টমীর দিন খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয়। সন্ধিপূজায় লুচি, সুজি, নাড়ু, মন্ডা ইত্যাদি ভোগরূপে দেওয়া হয়। নবমীতে অন্নভোগ, দশমীতে চিঁড়াভোগ।  বর্তমানে যে ভোগ রাঁধে তার নাম রূপক, প্রায়৩০-৩৫ বছর ধরে রাঁধছে। এখন তার সঙ্গে একজন সহকারীও থাকে। তার নাম শিবে। আমাদের বাড়ির আরও একটি বৈশিষ্ট এই যে, পুজোর সব কাজ অর্থাৎ ফুল সংগ্রহ, প্রসাদের ফল বনানো, মালা গাঁথা, নৈবেদ্য সাজানো, ঠাকুর বাড়ি পরিষ্কার রাখা, আরতির সময় ধুপ দীপ, ধুনো জ্বালিয়ে রাখা প্রভৃতি সব কাজ বাড়ির সবাই মিলেই করে থাকেন। আগে শুধু ছেলেরাই এই কাজে অংশগ্রহণ করত কিন্তু কালের প্রবাহে সেই সংকীর্ণতা ঘুচে গেছে। আবার কিছু কিছু কাজ দেখতাম এক একজন প্রতি বছর দায়িত্ব সহকারে করে। যেমন নীলদা ঠাকুরের গয়না পরাত, জগাদা সন্ধিপুজোর ১০৮ টি পদ্ম সুন্দর করে পাপড়ি খুলে খুলে সাজিয়ে দিত। সন্ধ্যারতির সময় ভারি ঘণ্টাটা বাজাত সন্তোষদা। ধুনো যাতে না নিভে যায় সেদিকে খেয়াল রাখত পীতুদা। কলাবউ সাজাত ছোড়দা। এমন আরও কত কি।  কত মানুষের ছোট্ট ছোট্ট সহায়তায় সম্পন্ন হতো এই বিরাট কর্মযজ্ঞ।

যখন ছোট ছিলাম তখন বাড়িতে মায়েরা দিদিরা সবাই পুজোর সময় বাড়িতেই ব্যস্ত থাকতেন। কবে থেকে শুরু হয়ে যেত নাড়ু, মুড়কি তৈরি করা। পুজোর ক’দিন ও তাদের ব্যস্ততার শেষ থাকত না। এতগুলি লোকের রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা তাদেরকেই দেখতে হত। পরবর্তীকালে বিশুদা সপ্তমীর দিন আর লালদা নবমীর দিন সবার দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করে। এই ব্যবস্থা বহুদিন চলেছিল। তারপরে আমি আমার দাদা ও অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে কথা বলে স্থির করি যে দশমীর দিনটাও যদি বাকি সবাই মিল একসঙ্গে খাওয়ার ব্যবস্থা হয় তাহলে বাড়ির বউ মেয়েদের আর রান্নাবান্নার জন্য ব্যস্ত হতে হয় না। আর অষ্টমীর দিন এমনিতেই বেশিরভাগ মানুষ উপবাস করতেন। আমার দাদা (মিহির কুমার) খেতে ও খাওয়াতে যারপরনাই ভালোবাসতেন। তাই এই প্রস্তাবে তাঁর উৎসাহই সবচেয়ে বেশি ছিল। এভাবে বেশ কিছু বছর চলার পরে দাদা স্বর্গগত হন (১৯৯৮ সালে)।  দাদা বিশুদা ও লালদার সমবয়সী ও পরম বন্ধু ছিলেন। তাই তিনি চলে যাবার পরে খাওয়ানো দাওয়ানোর ব্যাপারটা উঠে যায়। বর্তমানে ভোগের পরিমান অনেক বাড়ানো হয়েছে। সকলেই প্রতিদিন পুজোর পরে ভোগের প্রসাদ পান।

(ক্রমশ)

Author

  • রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়

    বর্ষীয়ান লেখক রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৫৫ সালে বীরভূমের সুরুল গ্রামে। তিনি তাঁর তেরো ভাইবোনের মধ্যে একাদশতম। গ্রামের সুরুল প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তারপরে বোলপুর উচ্চবিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করেন। এরপরে বিশ্বভারতীর পল্লীশিক্ষাভবনে যোগ দেন কৃষিবিদ্যায় স্নাতকস্তরের পড়াশোনার জন্য। সেইসময় পশ্চিমবঙ্গে কৃষিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পড়াশোনার সুবিধা ছিল না। কিন্তু নিজের মেধার যোগ্যতায় বৃত্তি-প্রাপ্ত হয়ে পাড়ি দেন উত্তরপ্রদেশের গোবিন্দ বল্লভ পান্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে তিনি স্নাতকোত্তর স্তরে কীটবিদ্যা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন ও সর্বশ্রেষ্ঠ থিসিস (best master's thesis) পুরস্কার প্রাপ্ত হন। স্নাতকোত্তর পড়ার সময়েই চাকরির সুযোগ আসে ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়াতে (যা বর্তমানে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত)। পড়া শেষ করেই সেখানে যোগদান করেন অফিসার হিসেবে। কৃষিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর হবার সুবাদে সেসময়ে গ্রামীণ চাষীদের ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সুবিধা ও অসুবিধা দেখাশোনার কাজই ছিল মুখ্য। কাজের সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় কাটাতে হয়েছে তাঁকে। শেষমেশ বাবা মায়ের টানে এসে থিতু হন সেই বোলপুরেই। বীরভূমের বিভিন্ন শাখায় কেটেছে বাকি কর্মজীবন। ২০১৬ সালে বীরভূমের আমোদপুর শাখা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনে ভারতবর্ষের বহু স্থানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। অবসর জীবনে বইপত্র পড়া, বাগান করা ও পূজা অর্চনাতে দিন কাটে। বিগত ১৫ বছর যাবৎ সুপ্রাচীন পারিবারিক দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করে আসছেন। পাশাপাশি সুবিশাল পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন তিনি। লেখক শ্রীমুখোপাধ্যায়ের কথায়, "প্রথাগতভাবে লেখালেখি করা হয়ে ওঠেনি কখনো। এখন অবসর জীবনে এসে একমাত্র মেয়ের আবদারে কলম ধরেছি।"

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল
গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল

    আমার শৈশব ভাড়াবাড়িতে। তাই গরমের ছুটিতে কাকু, জেঠুদের বাড়ি টানা একমাস ছুটি কাটাতে যেতাম। মামাবাড়িও যেতাম। ছেলেবেলার গরমকাল জুড়ে বেশ কিছু মজার স্মৃতি আছে

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    চাদিফাঁটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ
    গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

    চাঁদিফাটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ

      মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার সেইসব দিন, প্রচন্ড গরম থেকে স্বস্থির আরাম

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      শৈশবের গরমকাল: মধুরিমা বন্দ্যোপাধ্যায়
      গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

      শৈশবের গরমকাল: মধুরিমা বন্দ্যোপাধ্যায়

        শীত বুড়ির চাদর পেড়িয়ে যখন গ্রীষ্মকাল আসে দাবদাহ যেন ভৈরব সন্ন‍্যাসীর মতন তাড়া করে। আমাদের ছোটবেলায় মুঠোফোন অনেক দূরের ব‍্যাপার লোডশেডিং এর পাড়ায় কার্টুন দেখাও ছিল শক্ত কাজ।

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন