ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় হয় বোধন ও অধিবাস। বাড়ির সংলগ্ন পুকুর(বরিক গোরে) থেকে ঘট ভরে আনা হয়। আগে তামার তৈরি দুটি ঘটে এই কাজ হত। পরবর্তীকালে লালদা (ড. সুকুমার মুখোপাধ্যায়) তা রুপোর করে দেন। এরপর নবপত্রিকা অর্থাৎ নয়টি বৃক্ষকে একত্রে পুজো করা হয়। এই নয়টি বৃক্ষ হল— রম্ভা অর্থাৎ কলা, দাড়িম্ব অর্থাৎ ডালিম, মান অর্থাৎ মানকচু, কচবা অর্থাৎ কচু, হরিদ্রা অর্থাৎ হলুদ,বিল্ব অর্থাৎ বেল, ধান্য অর্থাৎ ধান, অশোক এবং জয়ন্তী। বেলের ডালের সঙ্গে জোড়া বেল থাকতে হবে। প্রতিটি বৃক্ষে এক একজন দেব-দেবী বিরাজমান বলে মানা হয়। রম্ভায় ব্রাহ্মণী, কচবিতে কালিকা, হরিদ্রায় দুর্গা, বিল্বতে শিবা, জয়ন্তীতে কার্ত্তিকী, অশোকে শোকরহিতা, দাড়িম্বে রক্তদন্তিকা মানে চামুন্ডা ও ধান্যে লক্ষ্মী। এঁদের প্রত্যেকের পুজো করা হয় যাতে পুজোর সময়কালীন ওঁরা ওইখানে অধিষ্ঠান করেন।
আমাদের পুজো ষোড়শপচার অর্থাৎ ষোলোটি উপচার দ্বারা করা হয়ে থাকে। এগুলি হল— গন্ধ, পুষ্প, শিলা, ধান্য, দূর্বা, ফল, দধি, ঘৃত, সিঁদুর, শঙ্খ, কজ্জ্বল (কাজল), কাঞ্চন, রৌপ্য, তাম্র, দর্পন ও দীপ। এই ষোলোটি উপচার একটি থালায় রাখা থাকে তাকে বলে ওলৎকাঁসা। ষষ্ঠীর দিন পুজোর সময়েই দেবদেবীর উদ্দেশে কেউ যদি কোনো বস্ত্র, অলংকার বা অন্যকিছু দিয়ে থাকেন তা উৎসর্গ করা হয়। পুজোর শেষে বাড়ির ছেলেরা মিলে প্রতিমাকে বেদিতে স্থাপন করে। এর আগে পর্যন্ত অর্থাৎ প্রতিমা নির্মাণ পর্যায়ে প্রতিমা বেদির নিচে নামানো থাকে। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, ষষ্ঠীর দিন বা তার আগের দিন সমস্ত ঠাকুরবাড়ি পরিষ্কার করে ধুয়ে বেদিতে এবং দোলায় সর্ষের তেল দিয়ে পালিশ করা হত। বেদির সংলগ্ন আলপনা দীর্ঘদিন যাবৎ আমার কাকিমা মহালক্ষ্মী দেবী দিতেন। এছাড়া প্রতিমা নিরঞ্জনের বাঁশ যাকে সাঙের বাঁশ বলা হতো, চলে আসত। সেই বাঁশ আবার কানাই বাউরি চেঁছে পরিষ্কার করে রাখত। দুটো বাঁশ অপেক্ষাকৃত লম্বা হত এবং ওই দিয়ে বেঁধে ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় বোধনের পর ঠাকুরের বেদিতে মা দুর্গাকে তোলা হত। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বোধনের পর দুটো সাঙের বাঁশ সুভাষদা ঠাকুরের পাটায় বাঁধত। পরে এই কাজটি ছোড়দা করত। ঠাকুর বেদিতে উঠে গেলে আমরা নিশ্চিন্ত হতাম। এখনও ওইভাবে হয় এখন বাড়ির ছেলেদের বদলে বেশ কিছু বাইরের ছেলে এই কাজে সহায়তা করে। অধিকরাত্রে নীলদা ঠাকুরের অস্ত্র ও গয়না পরিয়ে দিতেন। আমাদের প্রতিমার অস্ত্র রুপোর এবং অলংকার কিছু সোনার ও কিছু রুপোর।

দুর্গা প্রতিমার দশহাতে থাকে চক্র, অঙ্কুশ, ত্রিশূল, খড়গ, ধনুক, বাণ, ঢাল, গদা, কুঠার ও সর্প। লক্ষ্মীর হাতে থাকে পদ্ম ও মঙ্গলকলস, সরস্বতীর হাতে থাকে পদ্ম ও বীণা। গনেশের চার হাতে থাকে গদা, চক্র, শঙ্খ ও লাড্ডু। পূর্বে দীর্ঘকাল গণেশের হাতে একটি বৃহদাকার কদমা দেওয়া হত এবং দশমীর পরে সবাইকে তা ভাগ করে প্রসাদ দেওয়া হতো। কিন্তু আমি পুজো করার সময় গণেশ পুজোর মন্ত্রে লাড্ডুর উল্লেখ থাকতে দেখি এবং প্রস্তাব দিই কদমার বদলে লাড্ডু দিতে এবং বর্তমানে তাই দেওয়া হয়। অনুমান করি কদমা যেহেতু অনেকদিন পর্যন্ত ভালো থাকে এবং সেই আমলে গ্রামে লাড্ডুর প্রচলনও ছিল না বলে কদমার ব্যবহার হত। কার্তিকের হাতে থাকে ধনুর্বাণ, মহিষাসুরের হাতে ঢাল ও তলোয়ার। ২০০১ সালে মা দুর্গার ত্রিশূল ও মা সরস্বতীর বীনা এবং ২০০৩ সালে মা দুর্গার খড়গ ও ঢাল নতুন করে বড়ো আকারে নির্মিত হয়। তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে অন্য সকল অস্ত্রগুলিও সংস্কারের প্রয়োজন। সেইমতো বাকি সব অস্ত্রগুলিও নতুন করে বড়ো আকারে তৈরি করানো হয় এবং সেগুলিই এখনও ব্যবহার হচ্ছে।
এছাড়া, পুজোর আসন হিসেবে একটি হরিণের চর্মের আসন ব্যবহার হয়। সেটি যে কত প্রাচীন তা কেউ জানেনা, বহু ব্যবহারে আজ তার কোনও রোমের অস্তিত্ব নেই। তাই বর্তমানে আরেকটি নতুন আসন কেনা হয়েছে।