আমার স্মৃতিতে বাড়ির দুর্গাপূজা(৫ম পর্ব): রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়
আমরা জানি, পুজোর প্রথম ধাপ হল প্রতিমা নির্মাণ। প্রতিবছর রথযাত্রার দিনে প্রতিমার কাঠামো পুজো করে মাটি ছোঁয়ানো হয়। এরপর কাঠামোয় খড় বাঁধা হয় এবং প্রথম দফায় মাটি দেওয়া হয়। একে বলা হয় ‘একমাটি’। এইপর্যায়ে কেবল প্রতিমার শরীর নির্মাণ হয়। এর কিছুদিন পর হয় ‘দুই মাটি’। এই পর্যায়ে প্রতিমার হাত ও পায়ের আঙ্গুল এবং মুখ তৈরি হয়। এরপর ‘খড়ি’ অর্থাৎ সাদা রং লাগানো হয় ও তারপরে সাবুর আঠা। তারপর হয় আসল রঙের কাজ। রং হয়ে গেলে লাগানো হয় ঘামতেল। এরপর পুজোর কয়েকদিন আগে তৃতীয়া-চতুর্থী নাগাদ হয় বস্ত্র ও অলংকার পরানো বা ‘সাজ’। এইদিনই চুল, কেশর ইত্যাদি লাগানো হয়। সবশেষে হয় চক্ষুদান। আমাদের প্রতিমা একচালার হয় অর্থাৎ দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, মহিষাসুর সবই একচালার মধ্যে। প্রতিমার পিছনে লাগানো হয় চালচিত্র বা চালি। এরমধ্যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও অন্যান্য দেবদেবীর ছবি হাতে আঁকা হয়ে থাকে। মা দুর্গার মাথার ঠিক ওপরে হয় শিবের অবস্থান। এইভাবে প্রতিমা নির্মাণ সম্পন্ন হয়।

আমাদের ছোটবেলায় রাখহরি মিস্ত্রি প্রতিমা গড়ত। তার বাবাকেও(বুড়োমিস্ত্রি) প্রতিমার চোখ আঁকতে দেখেছি। কিন্তু মণ্ডপের চাতালে যে সবুজ দাগ ছিল তার বাইরে পর্যন্ত আমরা যেতে পারতাম। তার ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করলেই বুড়োমিস্ত্রি লাঠি দিয়ে ঠকঠক আওয়াজ করে ভয় দেখাতেন। আমাদের সাহস ছিল না তা অমান্য করি। রাখহরি মিস্ত্রির পিঠে একটা ছোট গর্ত ছিল। জিজ্ঞেস করলে বলত যুদ্ধে গুলি লেগে ওই গর্ত হয়ে গেছে। ছোটবেলায় ওই কথাই বিশ্বাস করতাম। ওই সময় ঠাকুরের মাটি তৈরি করত সীতানাথ বাগদি। আমরা তার কাছে একটু মাটি চাইলে বলত ঠাকুর তৈরি শেষ হলে পাওয়া যাবে। আমরা তাকেও খুব ভয় করতাম এবং খুবই বাধ্যতা দেখাতাম যাতে ঠাকুর গড়া শেষ হলে একটু মাটি পাই। তখন জানতাম না ঠাকুরের একমাটি কলাপুকুর থেকে আনা হয় আর দুইমাটি আসে বল্লভপুরের কোপাই নদীর পাড় থেকে। একমাটির সঙ্গে ধানের তুষ মেশানো হত। আবার ওই মাটির সঙ্গেই কুচো কুচো করে কাটা পাট মিশিয়ে ঠাকুরের হাত পায়ের আঙ্গুল ও গয়না তৈরি হত। মিস্ত্রিরা ঠাকুর গড়ার সময় আমাদের বাড়ি, নিত্যকাকা ও পূর্ণজ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে পালা করে খাওয়াদাওয়া করত। যখন ঠাকুর রং করতে আসত তখন কবে চোখ আঁকা হবে সেটা আমাদের কৌতূহলের বিষয় ছিল। বুড়োমিস্ত্রি বলত গভীর রাত্রে মা দুর্গা দাঁড়িয়ে দেখেন যখন চোখ আঁকা হয়। আসলে রাত্রি ১০টার পরে এমনভাবে ঘুমিয়ে পড়তাম যে আর ঠাকুরবাড়ি যাওয়া হত না। তখন ঠাকুরের চুল কিনতে পাওয়া যেত না। শনকে কালো রং করে তারপর সর্ষের তেল দিয়ে আঁচড়ে ঠাকুরের চুল তৈরী করা হতো। আমার ছোড়দা মিস্ত্রিদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ঠিক মাটি গয়না রং সাজ চুল একটু করে জোগাড় করে রাখতো এবং সুরুলের বাড়িতে একটি কালীঠাকুর নিজে হাতে তৈরি করত। ওইটি আমাদের খুব গর্বের জিনিস ছিল। টুকরো টিনের একটি ঘর করে সেখানে ঠাকুরটি রেখে কালীপুজোর রাত্রে পুজো করা হতো। পিঠোপিঠি ছিলাম বলে কিনা জানি না, ছোড়দা আমার অন্তরের অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছিল। একারণে আজ আর সুরুলের বাড়ি যেতে ইচ্ছেই করে না। মা দুর্গার পুজোর ম্যানেজার হওয়া, বসে পুজো করা প্রভৃতি সব কাজই ছোড়দা করেছে। যাইহোক, পরলোকে যেন তার আত্মার সদ্গতি হয়। আমার বাবা শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায় কালী বা শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন বলে প্রতিবছরই বাড়িতে ঠাকুরঘরে কালীপূজার রাত্রে কালিপূজা করতেন। এছাড়া ওইদিন সন্ধ্যায় একটি লক্ষ্মীপুজো আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে করতে হত এবং এখনো হয়। তবে এইপুজো আমাদের কুলপুরোহিত জগবন্ধু মুখোপাধ্যায় করতেন। ওইসময় লালদাদের বাড়ির নিচের তলায় লক্ষ্মীঠাকুর থাকতেন। বর্তমানে তা দুর্গামণ্ডপের নিত্যপূজার ঘরে রাখা আছে। রাখহরি মিস্ত্রির পরে অনেকবার আমাদের মিস্ত্রি বদল হয়েছে। একসময় বড়বাড়ির বর্তমান মিস্ত্রি সুভাষ এবং তার আগে তার বাবাও আমাদের প্রতিমা নির্মাণ করেছে। গত কয়েকবছর ধরে রামপ্রসাদ আমাদের প্রতিমা নির্মাণ করে। বর্তমানে ঠাকুরের কাঠামোটি একটু বড়ো করা হয়েছে পাশে কাঠ জুড়ে যেহেতু মন্দিরটি উঁচু হয়েছে। এখন আগের মতো মাটির মুকুট হয়না। তার বদলে রাংতার মুকুট হয়েছে। আগে গ্রামের মিস্ত্রিদের কাছে রাংতার মুকুট থাকত না তাই একবার লালদা কলকাতা থেকে রাংতার মুকুট এনে দিয়েছিলেন। তবে এখন সবই পাওয়া যায়। কখনো কখনো ডাকের সাজ এর প্রতিমাও তৈরি হয়েছে। মিস্ত্রীভেদে সাজও ভিন্ন ভিন্ন হয়। তবে অসুরের রং হয় সবুজ। কলকাতা বা অন্যান্য অনেক জায়গার প্রতিমাতেই অসুরকে ধূসর বা খয়েরি রঙে রাঙানো হয়ে থাকে। কিন্তু সুরুলের বাড়ির পুজোগুলিতে অসুরের রং সবুজ হয়।
কথক ঠাকুরের মতো গল্প শোনাচ্ছেন শ্রী রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়। দারুন লিখেছেন