আমার জন্ম ১৯৫৪ সালের আষাঢ় মাসে। সে-সময়ে আমাদের ঠাকুরবাড়ি ছিল মাটির তৈরি, তাতে টিনের চাল, বামদিক ও ডানদিকে দুটিঘর। গত ২০১১ সালে লালদার উদ্যোগে সকলে মিলে নতুন মন্দির নির্মিত হয়েছে। যদিও ঘরগুলির অবস্থান একই আছে।
বামদিকেরটি দুর্গা ও মাগঙ্গার নিত্যপূজার জন্য ব্যবহৃত এবং ডানদিকেরটি ভাঁড়ার ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ঠাকুরের বেদি তখন ছিল পাকা ও লাল রঙের চারদিকে কালো বর্ডার দেওয়া। এখন মার্বেলের হয়েছে। মন্দিরের সামনে একটি বারান্দা। মূল মন্দিরের সঙ্গে তফাৎ করার জন্য ছিল সবুজ রঙের বর্ডার লাইন। সিঁড়ির নিচে ডানদিকে মনসাতলা যেখানে দশহরা পূজার সময় একটি ত্রিখণ্ডি মনসাগাছের ডাল পুজো করে বসানো হতো এবং তারের নেট দিয়ে ঘেরা লোহার ফ্রেমের একটি চৌকোনা ঘেরাটোপ দিয়ে ঘেরা থাকতো। এই গাছটি প্রতি বছর দশমীর দিন নবপত্রিকার সঙ্গে নতুন পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়। এই মনসাতলায় প্রত্যেক পঞ্চমীতে বিশেষ পূজা এবং প্রত্যহ ধুপ, দীপ জ্বালানো হয়। মনসাতলার ঠিক পাশেই টগর গাছ এবং ঠিক তার বিপরীত দিকে আরও একটি টগর গাছ ছিল। টগর গাছের সামনেই বিরাটাকার বেলগাছ ছিল। বেলগাছটির চারপাশ বাধানোর জন্য মাটি খোঁড়া হয়েছিল আমার ছেলেবেলায় দেখেছি। শুনেছি জগাদা একটি স্বপ্ন পায় যে ওই বেলতলার কোনোরূপ পরিবর্তন করলে মুখার্জীবাড়ির কোনো বড়ো ক্ষতি হবে। ঐদিন রাত্রেই প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি হয়ে গাছটি পড়ে যায়। এবং এর কিছুদিনের মধ্যেই লালদার বাবা ধ্বজাধারী মুখার্জী প্রয়াত হন। বর্তমানে আগের বেলগাছের স্থানেই একটি নতুন বেলগাছ বসানো হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণদিকে আমার কাকিমার (চারুচন্দ্রের স্ত্রী) একটি শ্বেতপাথরের মূর্তি ঘরের মধ্যে স্থাপন করা আছে। আমার ছেলেবেলায় দেখেছি একরাত্রে হঠাৎ বাবুকাকা (চারুচন্দ্র) ট্যাক্সি করে কলকাতা থেকে তাঁর স্ত্রীর ওই মূর্তিটি নিয়ে আসে এবং একেবারে দুর্গামাতার সামনাসামনি দক্ষিণ দিকে ওই মূর্তিটি স্থাপন করা হয়। মূর্তিটি একটি তালপাতার ছাউনির নিচে রাখাছিল। পরে সুকুমার চট্টোপাধ্যায় ওরফে বোনপোর তত্ত্বাবধানে পাকাঘরটি তৈরি হয়। ঘরটি ঠাকুরবাড়ির এক কোনেও করা যেত কিন্তু কাকিমার চোখ যেন সোজাসুজি মাদুর্গার সমান্তরাল থাকে সেজন্যই ওখানে ঘরটি করা হয়। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়( সম্পর্কে আমার দাদু, যাকে আমি দেখেছি)-এর বাড়ি থেকে ঠাকুরবাড়ির সিঁড়ি পর্যন্ত বাঁধানো রাস্তা ছিল, বাকি ঠাকুরবাড়ির চাতাল কাঁচা অর্থাৎ মাটির। দুর্গাপূজার সাত দশ দিন আগেই ঠাকুরবাড়ি চুনকাম ঝাড়াপোঁছা হত এবং চাতাল ও আশেপাশের জায়গার ঘাস চেঁছে পরিষ্কার করা হত। ঠাকুরবাড়ির চাতালটি ২০২০ সালে টাইলস দিয়ে বাঁধানো হয়েছে।

এই পুজোয় মুখার্জী বাড়ির কোনও বংশধরই পৌরোহিত্য করেন। আগে পুরোহিত ও তন্ত্রধারক দুজনেই বাড়ির থেকে হতেন। বর্তমানে অন্য কোনও পুরোহিতকে তন্ত্রধারক হিসেবে বহাল করা হয়ে থাকে। প্রসঙ্গতঃ দুর্গাপুজো একটি বিরাট পুজো এবং তারজন্য এত নিয়মনিষ্ঠা পালনের প্রয়োজন যে একজন পুরোহিতের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এইকারণে, তন্ত্রধারক পুজোর মন্ত্র ও অন্যান্য বিধি তন্ত্র থেকে উল্লেখ করেন এবং পুরোহিত তা অনুসরণ করেন। আমি জ্ঞান হওয়া অবধি জ্যাঠামশাইকে(ওড়মবাপদ মুখোপাধ্যয়) পুজো করতে এবং আমার বাবাকে তন্ত্রধারকের কাজ করতে দেখেছি। আমার বাবা সংস্কৃতে খুবই পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু আমাদের কোনও ভাইকেই পূজাপদ্ধতি শেখাননি। একেবারে শেষবয়সে বলেছিলেন, “যদি বাল্যাবস্থা থেকে পয়সা রোজগার করতিস তাহলে লেখাপড়া হত না।” আজ ভাবি কতখানি দূরদর্শিতা ছিল তাঁর। বিভূতিভূষণ(সম্পর্কে দাদু) যখন পুজো করতেন তখন তন্ত্রধারক ছিলেন ভূধরচন্দ্র(সম্পর্কে জ্যাঠামশাই)। এর পরে জ্যাঠামশাই পূজক ও বিনয়ভূষণ কিছুদিন তন্ত্রধারক ছিলেন। তারপরে জ্যাঠামশাই ও বাবাকে পূজক ও তন্ত্রধারক হিসেবে দেখেছি প্রায় ১৯৭৭-৭৮ সন অবধি। তারপরে কিছুদিন তন্ত্রধারক ও পূজক ছিলেন যথাক্রমে আমাদের কুলপুরোহিত জগবন্ধু মুখোপাধ্যায়(জগুকাকা) ও তাঁরই ভাই মাধব মুখোপাধ্যায় (ফেলাকাকা) যিনি তাঁর নৃত্যকলার জন্য বিশ্বভারতীতে প্রসিদ্ধ ছিলেন। পরে আমার ছোড়দা বছরপাঁচেক পুজো করে তখনও জগুকাকা তন্ত্রধারক ছিলেন। তারপরে আমার জ্যাঠামশাইয়ের জ্যেষ্ঠপুত্র বিশ্বনাথ মুখার্জী ওরফে বিশুদা প্রায় ২০বছর ২০০৪ সাল অবধি পূজকের কাজ করেছে। এইসময় তন্ত্রধারক ছিলেন ফেলাকাকা ও তারপরে ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়(ইন্দ্রদা)। ২০০৫ সাল থেকে আমি পূজকের আসনে বসি এবং তন্ত্রধারক হিসেবে ইন্দ্রদাই থেকে যান। ইন্দ্রদা প্রায় ৩৫ বছর ধরে তন্ত্রধারকের কাজ করছেন। এছাড়া আমি ভূধরজ্যাঠামশাইকে পুজোর ম্যানেজার হিসেবে দেখেছি। ভূধর জ্যাঠামশাইয়ের পর আমার বাবা দুর্গাপুজোর ম্যানেজার হয়েছিলেন এবং তখন তিনি তন্ত্রধারকের কাজও করতেন। বাবা যখন ম্যানেজার হিসেবে ছিলেন তখন পুজোর ফুল আমি, ছোটন ও সুজিত ভোরবেলায় উঠে শ্রীনিকেতন থেকে বিভিন্ন কোয়ার্টারে গিয়ে তুলে নিয়ে আসতাম। আমাদের উৎসাহ প্রদানের জন্য বাবা ২৫ পয়সা ও পরে ৫০ পয়সা দিতেন। বাবার পরে ম্যানেজার ছিল ছোড়দা, সুনীলদা এবং তারপরে অশোকদা। অশোকদাই এখনো সেই কাজ করে চলছেন। প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে বিশুদার উদ্যোগে দুর্গাপুজোর জন্য দেবোত্তর ট্রাস্ট গঠন করা হয় এবং সেভাবেই এখনও পুজো চলে আসছে।