আমার স্মৃতিতে বাড়ির দুর্গাপূজা(তৃতীয় পর্ব): রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়
(আগের পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)
ওড়মবাপদ কর্মসূত্রে জামশেদপুরের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা সেখানেই মানুষ হন। এঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠপুত্র বিশ্বনাথ ওরফে বিশুদা ছিলেন প্রখ্যাত উকিল এবং দীর্ঘকাল দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করেছেন। তিনিই প্রথম মোটরগাড়ি কেনেন এবং আমৃত্যু সেই গাড়ি নিয়ে সপরিবারে পঞ্চমীর দিন থেকে একাদশী পর্যন্ত সুরুলে আসতেন এবং বয়সে সবার বড়ো হয়েও একাদশীর দিন সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিজয়া করতেন। এরপরের পুত্র জগন্নাথ ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, তারপরের পুত্র রবীন্দ্রনাথ ব্যাংক কর্মী এবং অপর দুই পুত্র হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ও নরেন্দ্রনাথ। শ্যামাপদ অর্থাৎ আমার পূজনীয় পিতৃদেব ওভারসিয়ার ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেন। এরপরে জরিপের কাজে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। অল্প বয়সে পিতৃ-মাতৃহীন হবার দরুন দাদা ওড়মবাপদকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন। কর্মসূত্রে বাইরে থাকার দরুন সুরুলের সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছিল। এই কারণে ওড়মবাপদ ভাই শ্যামাপদকে আদেশ করেন সুরুলে ফিরে গিয়ে সব দেখাশোনার ভার নিতে। দাদার আদেশ মান্য করে শ্যামাপদ সুরুলে ফিরে আসেন এবং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথের কাছে কর্মে নিযুক্ত হন। গুরুদেবের শ্যামলী গৃহের নকশা আমার পিতৃদেব-ই করেছিলেন। পরে সেই একই নকশায় সুরুলে আমাদের বসতবাটির তোরণটি নির্মাণ করেন। আমার বাবা তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের জন্য রথীন্দ্রনাথের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। আমরা ছয় ভাই ও সাত বোন। আমি তাদের মধ্যে একাদশতম। আমার মা অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন শান্ত, মিতভাষী। এতগুলি সন্তানের সুস্থভাবে জন্মদান ও প্রতিপালন করার জন্য অনেকেই মাকে খুব পয়মন্ত নারী বলে শ্রদ্ধা করতেন। আমরা ছয়ভাই হলাম মিহির ওরফে মুকাই ওরফে দাদা, আনন্দ ওরফে গোপাল ওরফে মেজদা, দেবকুমার ওরফে বাসু ওরফে ছোড়দা, রুদ্রকুমার ওরফে সজু (আমি), সুপ্রিয় ওরফে ছোটন এবং প্রশান্ত ওরফে ভাইটি। দাদা ও মেজদা বিশ্বভারতীতে গ্রন্থাগারিক (librarian) ছিলেন। ছোড়দা চাষাবাদ ও জমিজমা রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। সেজদাও কিছুদিন দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করেছে। আমি আর ছোটন ব্যাঙ্ক কর্মচারী ছিলাম এবং আমাদের ছোট ভাই স্কুলশিক্ষক। এতক্ষণ পর্যন্ত আমি শুধুমাত্র এই বংশের পুত্রসন্তানদের কথাই বলে চলেছি কিন্তু আমাদের পরিবারে কন্যাদের ভূমিকা অপরিসীম। আমার সাত দিদি হলেন—মমতা, নমিতা, সুনীতা, অনিতা, অসিতা, রীতা ও মিতা। বিশেষ করে উল্লেখ করব আমার সেজদি সুনীতা ওরফে সন্তুর কথা। আমার এই দিদি বিশ্বভারতীর গণিত বিভাগের স্নাতকোত্তর স্তরের প্রথম ব্যাচ (১৯৬৩-৬৫) এবং ১৯৬৭ সালে তিনি গণিতে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এখনকার দিনে ভাবলে বোঝানোই যাবে না যে, আজ থেকে ৫৪ বছর আগে গ্রামের একটি মেয়ের পক্ষে এটা কত বড় একটা সাফল্য ছিল! কত প্রতিকূলতা পেরিয়ে সেজদি এই যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন তা বলে বোঝানো যাবে না। সেই আমলে সেজদির কাছে আরও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাত্রার সুযোগও আসে, কিন্তু সেজদি বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসারের দায়িত্ব নেবার জন্য সেই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। আজীবন অবিবাহিত থেকে সেজদি আমাদের অভিভাবকের মতো রয়েছেন আর কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। আমার বাবা চিরদিনই শিক্ষার আলোয় সকলকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন তাই আমরা তেরো ভাইবোনই উচ্চশিক্ষিত ও স্বনির্ভর হতে পেরেছি। সেই আমলে আমার বাবার মানসিকতা অন্য অনেকের তুলনায় স্বতন্ত্র ছিল। তিনি তাঁর কোনও পুত্রের বিয়েতে পণ গ্রহণ করেননি অথচ সেইসময় পণ গ্রহণকেই সবাই স্বাভাবিক বলে মনে করত।

আমার পিসিমা উলাঙ্গিনী বাবাদের বড়ো আদরের একমাত্র বোন ছিলেন কিন্তু বিয়ের পর কলেরাতে তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় আঘাত পেয়ে আমার বাবা ঠিক করেন যে তিনি সব মেয়েদের বিয়ে বড়ো শহরে দেবেন, গ্রামে নয়। নিজে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন বলে ইঞ্জিনিয়ার জামাতাদের সঙ্গেই দিদিদের বিয়ে দেন। সেই আমলে তাঁরা ধানবাদ, জামশেদপুর, রাউরকেল্লা, মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) প্রভৃতি স্থানে বসবাস করতেন এবং প্রত্যেক বছর পুজোর সময় সুরুলে আসতেন।
আমার পিতামহের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন কালিকাপদ, তাঁর দুই পুত্র অশোক (বর্তমানে দুর্গাপুজোর ম্যানেজার) ও অজয়। আর মুখার্জী পরিবারের সর্বশেষ ভাগ অর্থাৎ আমার পিতামহের ভাই দোলগোবিন্দর পরিবার। দোলগোবিন্দের স্ত্রীকে আমরা বলতাম ‘গলসির দিদি(ঠাকুমা)।’ দোলগোবিন্দের একমাত্র পুত্র ছিলেন নিত্যগোপাল(সম্পর্কে আমার কাকা) এবং তাঁর স্ত্রীকে আমরা বলতাম ‘সিউড়ি কাকিমা’ কারণ তিনি সিউড়ির মেয়ে ছিলেন। এঁদের ছয় পুত্র সুশীল, সুনীল, সুভাষ, সন্তোষ, সরোজ ও সুজিত। এদের মধ্যে একমাত্র সরোজদাই জীবিত আছেন। সুনীলদা, সুভাষদা, ও সরোজদার পরিবার বোলপুর তথা সুরুলের বাসিন্দা। সুজিত আমার সমবয়সী ও বাল্যবন্ধু ছিল। এছাড়াও যাঁদের কথা উল্লেখিত হল না তাঁরা হলেন মুখার্জী বাড়ির বধূরা ও মেয়েরা। আমার পরম পূজনীয়া পিতামহী, প্রপিতামহীরা এবং আরও অগণিত মানুষ। সকলের সম্বন্ধে বিস্তারিত জানি না বা স্মৃতিতে নেই বলে এঁরা অনুল্লেখিতা রয়ে গেলেন। তাঁদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমাদের এই বংশের সবার ইতিহাসকে একত্রিত করে বংশলতিকা তৈরির অসাধ্যসাধন করেছে আমার কন্যা নবনীতা। ২০০৭ সালে এই বংশলতিকা তৈরি হয়।
গল্প পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে কেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবার তো পরের সংখ্যার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।