আমার স্মৃতিতে বাড়ির দুর্গাপূজা(১ম পর্ব): রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়
দুর্গাপুজো। বাঙালির চিরন্তন আবেগ। দেশেই হোক বা প্রবাসে, বাঙালির কাছে দুর্গাপুজোর মাহাত্ম্য একইরকম জোরালো। বর্তমানে অণু পরিবারে (nuclear family) চাকুরিরত বাবা মা আর তথ্যপ্রযুক্তির যুগে, সাবেককালের দুর্গাপুজোর ধারণা আর প্রায় নেই বললেই চলে। কিছু সনাতন পারিবারিক পুজো এখনো টিকে আছে ঠিকই, কিন্তু দেশে, বিদেশে সর্বত্র সর্বজনীন পুজোর ধারণাই বেশি প্রচলিত। যুগের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনও অবশ্যম্ভাবী তাই সবকিছুকেই মেনে ও মানিয়ে নিতে হয়। এছাড়া উপায়ান্তরই বা কি? লোকবল এবং সময় দুটোরই যে সাংঘাতিক অভাব। আর সবকিছুর অভাবকে অর্থ দিয়ে মেটানো যায় না। তবুও এই বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও যে সেই প্রাচীনকালের পারিবারিক পুজোর স্বাদ ও অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছি, তার জন্য নিজেকে যারপরনাই সৌভাগ্যশালী বলে মনে করি। কালের প্রবাহে হয়তো ধীরে ধীরে এইসব প্রাচীন নিয়মকানুন, প্রথা কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, তাই আমার অভিজ্ঞতা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।

জন্মসূত্রে আমি বীরভূম জেলার বোলপুরের সুরুলগ্রামের দক্ষিণপাড়ার মুখার্জীবাড়ির বংশধর। শুনেছি আমরা নাকি রামায়ণ রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝার উত্তরসূরী। এই সুরুলগ্রামকে কেন্দ্র করেই গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ গ্রামোন্নয়ন ও কৃষিবিদ্যায় উন্নতির বীজবপন করেছিলেন। সুরুল গ্রামের নানা স্থানে বহু প্রাচীন টেরাকোটা শিল্পের মন্দির আছে। অধিকাংশই শিবমন্দির। বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন পেশার মানুষ এখানে বসবাস করেন। আমার কাহিনি অবশ্য এই গ্রামকে নিয়ে নয়। আমার কাহিনি দুর্গাপুজো নিয়ে। বর্তমানে এইগ্রামে ১২টি পারিবারিক ও একটি সর্বজনীন দুর্গাপুজো হয়। এই পারিবারিক পুজোগুলির অধিকাংশই শতাধিকবর্ষ অতিক্রম করেছে। এত ক্ষুদ্র পরিসরে এতগুলি সুপ্রাচীন পারিবারিক পুজোর নিদর্শন সত্যিই বিরল।
এদের মধ্যে অন্যতম পুজো হলো সুরুলের জমিদার সরকারবাড়ির বড়োতরফের পুজো। এই পুজো প্রায় ২৮৭ বছরের পুরোনো। জাঁকজমকের দিক দিয়ে এরপরেই আসে সরকারবাড়িরই ছোটতরফের পুজো। কথিত আছে, কোনও একবার পুজোর সময় ছোটতরফের একজন বউকে বড়তরফের কেউ পুজোর অগ্রাধিকার নিয়ে অপমান করেছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ ফিরে এসে তাঁর ছেলেদের বলেন যে তাঁর জন্য আলাদাভাবে পুজোর ব্যবস্থা না হলে তিনি জলগ্রহণ করবেন না। মাতৃআদেশে তাঁর ছেলেরা আলাদাভাবে পুজোর ব্যবস্থা করেন। ঘটনাচক্রে আমার পিতামহ শ্রীপঞ্চানন মুখার্জী ছিলেন ওঁদের বাড়ির কুলপুরোহিত এবং এইপুজোর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এ গল্প তাঁকে নিয়েও নয়। এ গল্প আমাদের মুখার্জীবাড়ির দুর্গাপুজোর। তবে তার বর্ণন করার আগে বলে নিই আমাদের পরিবারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
সুরুল দক্ষিণপাড়া মুখার্জীবাড়ির দুর্গাপুজোর প্রচলন ঠিক কবে, কে করেছিলেন তার কোনও নথি আমার হাতে পড়েনি। জনশ্রুতি এই যে, এই পুজো প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো। গুরুদেবের আদেশে আমার সপ্তম পূর্বপুরুষ এই গ্রামে বসবাস শুরু করেন। আগেই বলেছি, আমরা কৃত্তিবাস ওঝার উত্তরসূরী। সেই কারণেই কিনা জানিনা, আমার পূর্বপুরুষদের নাম রামের নাম দিয়ে রাখা হয়েছিল। লোকমুখে শুনেছি, আমার ঊর্ধ্বতন সপ্তম পূর্বপুরুষ ছিলেন রামচন্দ্র, তস্যপুত্র রামতারণ, তস্যপুত্র রামচরণ ও তস্যপুত্র রামশরণ। প্রথমে তাঁরা সুরুল উত্তরপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। উত্তরপাড়াতেই গুরুদেবেরও বাড়ি ছিল। পরে দক্ষিণপাড়ায় বাড়ি কিনে সেখানে বসবাস শুরু করেন। সেই বাড়িটি ছিল ইংরেজ আমলের মুনসেফখানা। সেই বাড়ির বয়স প্রায় তিন-চারশো বছর হবে। একসময় ওই বাড়ির চিলেকোঠায় রামচন্দ্রের বালী বধের দৃশ্য খোদাই করা ছিল। আজ সেই বাড়ির ভঙ্গুর অবস্থা। ঠিক কোন পূর্বপুরুষের আমলে দক্ষিণপাড়ায় বসবাস শুরু হয়েছিল জানিনা। তবে বর্তমানে ওই বাড়ির স্বত্ব রামশরণের পুত্র যদুনাথের পুত্র বিনয়ভূষণের বংশধরদের। রামশরণের দুই পুত্র ছিলেন যদুনাথ ও বেণীমাধব।
(ক্রমশ)
এই লেখা পড়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। যেভাবে উপস্হাপনা করা হয়েছে তাতে আমি চমৎকৃত। নবতরু আর ও অনেক বিস্তার লাভ করুক ও দীর্ঘায়ু হয়ে মানুষের অন্তঃস্হলে জায়গা করে নিক, পরম পিতার কাছে এই প্রার্থনা জানাই।