পুজোর নির্ঘণ্ট জমিদারবাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে ব্রাহ্মণেরা বসে নির্ধারণ করেন। সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয় গ্রামের বাইরে নতুনপুকুরে। সেখানে আটটি বাড়ির নবপত্রিকা স্নান করে। ছোটবাড়ির নবপত্রিকা ময়রাপুকুরে স্নান করানো হয়। নবপত্রিকার মধ্যে যে গাছ বা পাতাগুলি থাকে সেগুলিকে একত্রিত করে হলুদ কাপড় দিয়ে জড়িয়ে পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় এবং দোলার মধ্যে বসিয়ে বাদ্যসহকারে নতুনপুকুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে স্নান করানোর পর নবপত্রিকা আবার দোলায় স্থাপন করে ঢাকা দেওয়া হয়। এরপরে শুরু হয় ঢোলের খেলা। প্রত্যেক বাড়ির ঢুলেদাররা নানারকম বাদ্যের খেলা দেখায়। এই নবপত্রিকা স্নান ও ঢোলের খেলা দেখতে দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন। এরপরে বাদ্যসহকারে নবপত্রিকা চণ্ডীমণ্ডপে আনা হয়। সঙ্গে দুটি ঘটেও জল ভর্তি করে এনে ঠাকুরবাড়িতে দাঁড়ানোর পর যারা বহন করে এনেছে তাদের পা ধুইয়ে নবপত্রিকাকে বরণ করেন কোনো এয়োস্ত্রী এবং একজন এয়োস্ত্রীই মঙ্গলঘট ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমাদের অষ্টকলস স্নান মনসাতলার পাশে বসে নবপত্রিকাকে করানো হয়, তারপর মাথায় করে পত্রিকাকে বেদির বাম পাশে স্থাপন করে বেনারসি কাপড়ে সজ্জিত করা হয়। এর পাশে মহাদেবের একটি লোহার বড়ো ত্রিশূল রাখা হয়। নবপত্রিকাকে একটি লাঠির সাহায্যে লম্বা করে বেঁধে নবপত্রিকাবাসিনী দুর্গার রূপ দেওয়া হয়। কাগজের মধ্যে ত্রিনয়নী মুখের ছবিটি জীবাই স্যাকরার ছেলে বর্তমানে দিয়ে যায়। বংশপরম্পরায় ওরাই এটি দিয়ে যাচ্ছে। এই মুখটি নবপত্রিকায় লাগিয়ে বেনারসি কাপড় পরিয়ে গহনা ইত্যাদি পরানোর কাজটি আমার ছোড়দাই বরাবর করতো।

বর্তমানে আমার ছোটভাই প্রশান্ত বা সরোজদা করে থাকে। ছোটবেলায় জানতাম এটি কলাবউ বা গণেশের বউ। কিন্তু এখন পূজক হিসেবে জেনেছি এটি-ই মুখ্যত দুর্গাপূজায় পূজ্য। এর এক একটি পাতায় এক এক শক্তিদেবীর অধিষ্ঠান যা পূর্বে উল্লেখ করেছি। কলাবউ তৈরি হয়ে গেলে পুজোর জায়গাটি চৌকো আকৃতি গ্রিল দিয়ে ঘেরা হয়। ঘটে দুটি প্রতিমার সামনে নামিয়ে সিঁদুর, পল্লব, হার, আলতা(লালসুতো) দাবি, পুষ্প, দূর্বা ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে পূজায় বসা হয়। আচমন, বিষ্ণুস্মরণ, স্বস্তিবাচন, সূর্যপ্রনাম, সংকল্প, ঘটস্থাপন এবং ইত্যাদি করে সপ্তমীতে চক্ষুদান, প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে মূল পূজা শুরু হয়। ঠাকুরের কাঠামোর নিচে একটি বড় লোহার ছুরি রাখা হয়। এটি দিয়েই সন্ধিপূজায় মাসকলাই বলি দেওয়া হয়। পূজার আগে ফলমূল কেটে থালায় সাজিয়েও নৈবেদ্য সাজিয়ে প্রতিমার দক্ষিণদিক অর্থাৎ আমাদের বামদিকে রাখা হয়। পূজা শেষে পুষ্পাঞ্জলি, চন্ডীপাঠ, অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি ও পরে শীতল(লুচি, মিষ্টি, দুধও পান) দিয়ে ঠাকুরকে শয়ন দেবার প্রথা বরাবর দেখে এসেছি। সপ্তমীর সকালে সেই নির্ঘন্ট অনুযায়ী দোলা-র (পালকি জাতীয় কাঠের তৈরি একটি জিনিস) মধ্যে নবপত্রিকাকে রাখা হয় ও স্নান করানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট পুকুরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই নবপত্রিকা স্নান আমাদের গ্রামের একটি দর্শনীয় বস্তু। জমিদারবাড়ির ছোটতরফ ছাড়া বাকি সববাড়ির নবপত্রিকা একইসঙ্গে একই পুকুরে স্নান করানো হয়। পাড়ে দাঁড়িয়ে তন্ত্রধারকেরা মন্ত্রোচ্চারণ করেনও পুরোহিতরা নবপত্রিকাকে নানাবিধ সামগ্রী দ্বারা স্নান করান। প্রত্যেক বাড়ির দোলা একই সারিতে পরপর রাখা থাকে। সর্বপ্রথমে জমিদারবাড়ি, তারপরে আমাদের বাড়ি তারপর গোস্বামীবাড়ি প্রভৃতি।
ওলৎকাঁসার সামগ্রী এবং সেইসঙ্গে নানাবিধ পবিত্র জল দ্বারা নবপত্রিকা স্নান করানো হয়ে থাকে। এগুলি হলো বৃষ্টি, গঙ্গা সরস্বতী সাগর, পদ্মরজমিশ্রিত নির্ঝরোদক, সর্বতীর্থ প্রভৃতি। স্নানপর্ব সমাপন হলে নবপত্রিকাকে পুনরায় দোলায় স্থাপন করা হয়। এরপর শুরু হয় ঢোলের খেলা। প্রতিটি বাড়ির ঢুলেদারদের দোল তাদের বাজনার কেরামতি দেখায়। ইতিমধ্যে দোলা নিয়ে প্রবেশের সময় হয়ে এলে সবাই আবার সারিবদ্ধ ভাবে যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে দোলা নিয়ে গমন করে। ওদিকে বাড়ির বউরা স্নান সেরে দোলাপ্রবেশের জন্য অপেক্ষা করে। বাড়ির সধবা বড়বউ দোলা নেওয়া অবস্থাতেই দোলাবাহকদের পা ধুইয়ে দেন। তারপর দোলামধ্যস্থ নবপত্রিকাকে বরণ করে পান ও নাড়ু হরির লুট দেওয়া হয়।
(ক্রমশ)