Recent Post

আমার স্মৃতিতে বাড়ির দুর্গাপূজা(৮ম পর্ব): রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়

(আগের পর্বটি পড়ুন)

পুজোর নির্ঘণ্ট জমিদারবাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে ব্রাহ্মণেরা বসে নির্ধারণ করেন। সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয় গ্রামের বাইরে নতুনপুকুরে। সেখানে আটটি বাড়ির নবপত্রিকা স্নান করে। ছোটবাড়ির নবপত্রিকা ময়রাপুকুরে স্নান করানো হয়। নবপত্রিকার মধ্যে যে গাছ বা পাতাগুলি থাকে সেগুলিকে একত্রিত করে হলুদ কাপড় দিয়ে জড়িয়ে পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় এবং দোলার মধ্যে বসিয়ে বাদ্যসহকারে নতুনপুকুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে স্নান করানোর পর নবপত্রিকা আবার দোলায় স্থাপন করে ঢাকা দেওয়া হয়। এরপরে শুরু হয় ঢোলের খেলা। প্রত্যেক বাড়ির ঢুলেদাররা নানারকম বাদ্যের খেলা দেখায়। এই নবপত্রিকা স্নান ও ঢোলের খেলা দেখতে দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন। এরপরে বাদ্যসহকারে নবপত্রিকা চণ্ডীমণ্ডপে আনা হয়। সঙ্গে দুটি ঘটেও জল  ভর্তি করে এনে ঠাকুরবাড়িতে দাঁড়ানোর পর যারা বহন করে এনেছে তাদের পা ধুইয়ে নবপত্রিকাকে বরণ করেন কোনো এয়োস্ত্রী এবং একজন এয়োস্ত্রীই মঙ্গলঘট ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমাদের অষ্টকলস স্নান মনসাতলার পাশে বসে নবপত্রিকাকে করানো হয়, তারপর মাথায় করে পত্রিকাকে বেদির বাম পাশে স্থাপন করে বেনারসি কাপড়ে সজ্জিত করা হয়। এর পাশে মহাদেবের একটি লোহার বড়ো ত্রিশূল রাখা হয়। নবপত্রিকাকে একটি লাঠির সাহায্যে লম্বা করে বেঁধে নবপত্রিকাবাসিনী দুর্গার রূপ দেওয়া হয়। কাগজের মধ্যে ত্রিনয়নী মুখের ছবিটি জীবাই স্যাকরার ছেলে বর্তমানে দিয়ে যায়। বংশপরম্পরায় ওরাই এটি দিয়ে যাচ্ছে।  এই মুখটি নবপত্রিকায় লাগিয়ে বেনারসি কাপড় পরিয়ে গহনা ইত্যাদি পরানোর কাজটি আমার ছোড়দাই বরাবর করতো।

বর্তমানে আমার ছোটভাই প্রশান্ত বা সরোজদা করে থাকে। ছোটবেলায় জানতাম এটি কলাবউ বা গণেশের বউ। কিন্তু এখন পূজক হিসেবে জেনেছি এটি-ই মুখ্যত দুর্গাপূজায় পূজ্য। এর এক একটি পাতায় এক এক শক্তিদেবীর অধিষ্ঠান যা পূর্বে উল্লেখ করেছি। কলাবউ তৈরি হয়ে গেলে পুজোর জায়গাটি চৌকো আকৃতি গ্রিল দিয়ে ঘেরা হয়। ঘটে দুটি প্রতিমার সামনে নামিয়ে সিঁদুর, পল্লব, হার, আলতা(লালসুতো) দাবি, পুষ্প, দূর্বা ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে পূজায় বসা হয়। আচমন, বিষ্ণুস্মরণ, স্বস্তিবাচন, সূর্যপ্রনাম, সংকল্প, ঘটস্থাপন এবং ইত্যাদি করে সপ্তমীতে চক্ষুদান, প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে মূল পূজা শুরু হয়। ঠাকুরের কাঠামোর নিচে একটি বড় লোহার ছুরি রাখা হয়। এটি দিয়েই সন্ধিপূজায় মাসকলাই বলি দেওয়া হয়। পূজার আগে ফলমূল কেটে থালায় সাজিয়েও নৈবেদ্য সাজিয়ে প্রতিমার দক্ষিণদিক অর্থাৎ আমাদের বামদিকে রাখা হয়। পূজা শেষে পুষ্পাঞ্জলি, চন্ডীপাঠ, অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি ও পরে শীতল(লুচি, মিষ্টি, দুধও  পান) দিয়ে ঠাকুরকে শয়ন দেবার প্রথা বরাবর দেখে এসেছি। সপ্তমীর সকালে সেই নির্ঘন্ট অনুযায়ী দোলা-র (পালকি জাতীয় কাঠের তৈরি একটি জিনিস) মধ্যে নবপত্রিকাকে রাখা হয় ও স্নান করানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট পুকুরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই নবপত্রিকা স্নান আমাদের গ্রামের একটি দর্শনীয় বস্তু। জমিদারবাড়ির ছোটতরফ ছাড়া বাকি সববাড়ির নবপত্রিকা একইসঙ্গে একই পুকুরে স্নান করানো হয়। পাড়ে দাঁড়িয়ে তন্ত্রধারকেরা মন্ত্রোচ্চারণ করেনও পুরোহিতরা নবপত্রিকাকে নানাবিধ সামগ্রী দ্বারা স্নান করান। প্রত্যেক বাড়ির দোলা একই সারিতে পরপর রাখা থাকে। সর্বপ্রথমে জমিদারবাড়ি, তারপরে আমাদের বাড়ি তারপর গোস্বামীবাড়ি প্রভৃতি।

ওলৎকাঁসার সামগ্রী এবং সেইসঙ্গে নানাবিধ পবিত্র জল দ্বারা নবপত্রিকা স্নান করানো হয়ে থাকে। এগুলি হলো বৃষ্টি, গঙ্গা সরস্বতী সাগর, পদ্মরজমিশ্রিত নির্ঝরোদক, সর্বতীর্থ প্রভৃতি। স্নানপর্ব সমাপন হলে নবপত্রিকাকে পুনরায় দোলায় স্থাপন করা হয়। এরপর শুরু হয় ঢোলের খেলা। প্রতিটি বাড়ির ঢুলেদারদের  দোল তাদের বাজনার কেরামতি দেখায়। ইতিমধ্যে দোলা নিয়ে প্রবেশের সময় হয়ে এলে সবাই আবার সারিবদ্ধ ভাবে যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে দোলা নিয়ে গমন করে। ওদিকে বাড়ির বউরা স্নান সেরে দোলাপ্রবেশের জন্য অপেক্ষা করে। বাড়ির সধবা বড়বউ দোলা নেওয়া অবস্থাতেই দোলাবাহকদের পা ধুইয়ে দেন। তারপর দোলামধ্যস্থ নবপত্রিকাকে বরণ করে পান ও নাড়ু হরির লুট দেওয়া হয়। 

(ক্রমশ)

Author

  • রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়

    বর্ষীয়ান লেখক রুদ্র কুমার মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৫৫ সালে বীরভূমের সুরুল গ্রামে। তিনি তাঁর তেরো ভাইবোনের মধ্যে একাদশতম। গ্রামের সুরুল প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তারপরে বোলপুর উচ্চবিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করেন। এরপরে বিশ্বভারতীর পল্লীশিক্ষাভবনে যোগ দেন কৃষিবিদ্যায় স্নাতকস্তরের পড়াশোনার জন্য। সেইসময় পশ্চিমবঙ্গে কৃষিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পড়াশোনার সুবিধা ছিল না। কিন্তু নিজের মেধার যোগ্যতায় বৃত্তি-প্রাপ্ত হয়ে পাড়ি দেন উত্তরপ্রদেশের গোবিন্দ বল্লভ পান্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে তিনি স্নাতকোত্তর স্তরে কীটবিদ্যা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন ও সর্বশ্রেষ্ঠ থিসিস (best master's thesis) পুরস্কার প্রাপ্ত হন। স্নাতকোত্তর পড়ার সময়েই চাকরির সুযোগ আসে ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়াতে (যা বর্তমানে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত)। পড়া শেষ করেই সেখানে যোগদান করেন অফিসার হিসেবে। কৃষিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর হবার সুবাদে সেসময়ে গ্রামীণ চাষীদের ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সুবিধা ও অসুবিধা দেখাশোনার কাজই ছিল মুখ্য। কাজের সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় কাটাতে হয়েছে তাঁকে। শেষমেশ বাবা মায়ের টানে এসে থিতু হন সেই বোলপুরেই। বীরভূমের বিভিন্ন শাখায় কেটেছে বাকি কর্মজীবন। ২০১৬ সালে বীরভূমের আমোদপুর শাখা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনে ভারতবর্ষের বহু স্থানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। অবসর জীবনে বইপত্র পড়া, বাগান করা ও পূজা অর্চনাতে দিন কাটে। বিগত ১৫ বছর যাবৎ সুপ্রাচীন পারিবারিক দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করে আসছেন। পাশাপাশি সুবিশাল পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন তিনি। লেখক শ্রীমুখোপাধ্যায়ের কথায়, "প্রথাগতভাবে লেখালেখি করা হয়ে ওঠেনি কখনো। এখন অবসর জীবনে এসে একমাত্র মেয়ের আবদারে কলম ধরেছি।"

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল
গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল

    আমার শৈশব ভাড়াবাড়িতে। তাই গরমের ছুটিতে কাকু, জেঠুদের বাড়ি টানা একমাস ছুটি কাটাতে যেতাম। মামাবাড়িও যেতাম। ছেলেবেলার গরমকাল জুড়ে বেশ কিছু মজার স্মৃতি আছে

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    চাদিফাঁটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ
    গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

    চাঁদিফাটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ

      মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার সেইসব দিন, প্রচন্ড গরম থেকে স্বস্থির আরাম

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      শৈশবের গরমকাল: মধুরিমা বন্দ্যোপাধ্যায়
      গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

      শৈশবের গরমকাল: মধুরিমা বন্দ্যোপাধ্যায়

        শীত বুড়ির চাদর পেড়িয়ে যখন গ্রীষ্মকাল আসে দাবদাহ যেন ভৈরব সন্ন‍্যাসীর মতন তাড়া করে। আমাদের ছোটবেলায় মুঠোফোন অনেক দূরের ব‍্যাপার লোডশেডিং এর পাড়ায় কার্টুন দেখাও ছিল শক্ত কাজ।

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন