আমার শৈশব – দীপ্তেশ চট্টোপাধ্যায়
আজ লিখতে বসে মেঘের ঘনঘটা আর মেঘ রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলার সাক্ষী হয়ে আবেগী এ মন উদাস পারাপারের খেয়ায় ভেসে যেতে বসেছে। ছেলেবেলার টুকরো কিছু স্মৃতি মানসপটে দিকভ্রান্তের মতো হানা দিচ্ছে বারবার। ফেলে আসা শৈশবের পাতা ওলটালে মনে পড়ে যাচ্ছে সেই হারানো দিনগুলো কতই না সহজ সরল ছিলো। আধুনিকতার মায়াজালে আজ যদিও সেসব অতীত। তবুও এই নস্ট্যালজিয়ায় আক্রান্ত হবার লোভ সামলাতে পারলাম না। ছক কাটা বারান্দায় সেই রোদ্দুরে রাখা আচারের বয়াম এর গন্ধ আজও যে পিছু ডাকে। ক্লান্ত দুপুরে ঘুঘুর ডাক মনখারাপের বার্তা নিয়ে এসে মনে করিয়ে দেয়- “আজ যে কত বড় হয়ে গেছি!”

শৈশবের পথের যাত্রী হয়ে থাকার মতন ভালোলাগা আর কিছুতে আছে বলে জানা নেই। মনে পড়ে এখনো সেই ছেলেবেলার রবিবারের দুপুরে ‘শক্তিমান’ দেখার মধুর স্মৃতির কথা। সে আজ শক্তিহীন। পুজোর দোরগোড়ায় এসে আজও কানে বাজে “চিরসাথী শালিমার”। কখনও বা এলোপাতাড়ি হাওয়ার দাপটে টেবিলে রাখা ইতিহাস বইয়ের এলোমেলো পাতায় পানিপথ-যুদ্ধের অধ্যায় আমার জীবনযুদ্ধের ইতিহাসের রঙিন পাতাগুলিকে অবসর সময়ে মনে করিয়ে দেয়। শৈশবের স্কুল, টিফিন-আওয়ারে বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি, খেলার মাঠের প্রাণখোলা চঞ্চলতা বা টিউশন ফেরা আড্ডা হারিয়ে গেছে, আর এরই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া অ্যান্টেনা, রেডিও আর ল্যান্ডফোন এ বেলা বোসের সেই কণ্ঠস্বর মুঠোফোন এর দৌলতে অজানা পথের পথিক হয়েছে। কোনো কোনো গ্রীষ্মের দুপুরে আইসক্রিম বিক্রেতার সেই ‘হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা’-র মতো মনোহরণকারী ঘণ্টাধ্বনি আজ ব্র্যান্ডেড আইসক্রিম এর দৌলতে ফিকে।
মনে পড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের বারান্দার সামনে জমে থাকা জলে ভাসাতাম এক টুকরো কাগজের তৈরি ছোট্ট নৌকা। আজও বৃষ্টি হয়, সেখানে জলও জমে, কিন্তু বৃষ্টি ভেজার ভয়ে কেউ আর নৌকা ভাসায় না। ঝড়ের বিকালে আম কুড়ানো আর প্রখর রৌদ্রে ইটের উইকেটে একটি চেলা কাঠ ও বল হাতে খেলার সেই মজাই ছিল আলাদা। আধুনিকতার আবেশে গা ভাসিয়ে সেটা আজ প্রবেশ করেছে কম্পিউটার গেমস-এ। গল্পদাদুর আসরের জন্য মনের ব্যাকুলতা আজও অনুভব করি। ফেলে আসা ফাল্গুনের দুপুরে “চোখ গেলো” পাখির ডাক আর সেই দীপ্ত বিকেলের মায়াময় রোদ্দুর, যা আজও মনে করিয়ে দেয় অমলকান্তি কবিতার বিখ্যাত লাইন ” আমি রোদ্দুর হতে চেয়েছিলাম”।
কত সহজ স্বাভাবিকই না ছিল সেই মধুর জীবন! আজ পেরিয়ে এসেছি দেড় যুগ,স্মৃতির মালায় গাঁথা হয়ে আজও সেসব দিন আগমনীর বার্তা বয়ে নিয়ে আসা শরতের কাশ ফুল আর পেঁজা তুলোর মেঘের মতন জীবন্ত। আজও পরিশ্রান্ত দুপুর, ঝড়ের বিকেল ,লালচে গোধূলি, সান্ধ্য-আকাশ, নিশীথের একটানা ঝিঁঝি মুখর প্রহর আর পূর্ণিমা রাতে গাছের ডালের আটকে থাকা রূপালী চন্দ্রালোক মোহময়তার অন্তরালে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোন সুদূরে। সেই স্মৃতি এখনও বইয়ের পাতার ভাঁজে লুকানো শুকনো ফুলের মতই টাটকা। তন্দ্রামগ্ন মনে ভেজা মাটির গন্ধ মেশানো বিশুদ্ধ মেঠো বাতাস বয়ে আনে বিষাদের সুর। তন্দ্রা ভেঙে যায় এক লহমায়, হোয়াৎস্যাপ-এ ভেসে আসা মেসেজ এর শব্দে সম্বিৎ ফেরে। কারা যেন বলে ওঠে “ওয়েক-আপ এণ্ড লেটস্ কনসেনট্রেট অন ইওর জব!”