ওদিকে ঋজু এই সমস্ত কোলাহলের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে পাড়ার একমাত্র বাড়ির সামনে যার ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে, দেখেই বোঝা যায় এই বাড়িটিতে মানুষ আছে। বাড়িটা শ্রী-র কিংবা বলা ভাল শ্রী-দের, তবে অবশ্য এখন শ্রী একাই রয়েছে এখানে। শ্রীকে জন্মদিতে গিয়ে তার মা মারা যান। ছোটোবেলা থেকেই শ্যামলবাবুর একার আদর ও যত্নে শ্রী-র বেড়ে ওঠা। মেয়ের কলেজের কীর্তির ধাক্কাটা সইতে পারেননি। মেয়ে চলে যাওয়ার পর বাড়ি থেকে বেরোনো কমিয়ে দিয়েছিলেন। কতটা লজ্জায়, কতকটা আপমানে আর কতকটা তার মেয়ের সম্পর্কে মানুষের অতিরিক্ত কৌতূহলের কারণে। কয়েকদিন পর সকালে ঋজু তমালরা দেখা করতে গিয়েছিল শ্যামলবাবুর সঙ্গে। কিন্তু অনেক ডাকাডাকি করার পরেও যখন মানুষটির কোনো সাড়া শব্দ মেলে না তখন দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকা হয় এবং বেডরূমে শ্যামল বাবুর নিথর দেহটা পাওয়া তার, খোলা চোখে প্রানহীন একটা হাত খাটের পাশে ঝুলছে। পাড়ার ডাক্তার বোস এসে জানান ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে ভোরেই….,পাড়ার লোকেরা নিজেরাই শেষকৃত্য সম্পন্ন করে। শ্রীকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি কেউ কেউ। ঋজু একবার কথাটা বলার চেষ্টা করলেও তাকে ধমকে থামিয়ে দেওয়া হয়। তবে শ্রী পরে জানতে পেরেছিল, মাধ্যমটা অবশ্য ঋজু জানে না।
ঋজু দরজার কয়েকবার টোকা দিল। ভেতর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল, ”আসছি।”

কয়েক সেকেন্ড পর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল শ্রী। ঋজুকে দেখে বলল, “তুই এখানে? আয় ভেতরে আয়।”
ঋজু উত্তর দিল, “না, এখন নয়”, কথাটা শোনা মাত্রই শ্রী-র কন্ঠে একরাশ শ্লেষ ঝরে পড়ল, “আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম কোনো ভদ্রলোক মাথা উঁচু করে এ বাড়ির ভেতরে আসতে পারে না। সরি, আমারই ভুল হয়েছে।”
ঋজু বুঝতে পারে কালকের অপমানটা এখনও বিঁধছে, সে কিন্তু কিন্তু করে বলে, “তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি মন্ডপে, সেই কালকের পর তো আর যাওনি।”
“যাওয়াটা কি উচিত?” শ্রী উওর দেয়। “যেখানে এতটা আপমান হয়, তাছাড়াও তুই যে আমায় নিয়ে যেতে এসেছিস সেটা আর কেউ জানে? জানলে তোকেও কিন্তু ছেড়ে কথা বলবে না ওরা।”
“সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না, আমি কথা দিচ্ছি কেউ কিচ্ছু বলবে না” প্রত্যুত্তরে ঋজু জানাল।
আসলে শ্রী জানে না যে গতকাল তার আসার খবর পেয়ে পাড়ার সদস্যরা রায় কাকুর বাড়িতে ছোট্ট একটা মিটিং করেছে। সেখানে প্রায় প্রত্যেকের বক্তব্য ছিল যে, শ্রীকে এখনি পাড়া থেকে চলে যেতে বলা হোক, কে কখন তাকে চিনে ফেলে তখন আবার পাড়ার বদনাম। তবে ঋজুর বক্তব্য কিছুটা আলাদা, তার মতে পুজোটা সবার আর কাউকে যদি এর থেকে জোর করে বঞ্চিত করা হয় তবে সে আর সামনে বছর থেকে এ পুজোতে নেই, শ্রী এর সমর্থনে এ ধরনের কথা বলার জন্য ঋজুর বাবা অর্থাৎ প্রফেসর সাহেব-সহ আরও কয়েকজনের কাছে থেকে গঞ্জনাও সহ্য করতে হয়েছিল। মাঝখান থেকে রায়কাকু অর্থাৎ অখিলেশ রায়, একটা মধ্যস্থতা করে দেন, উনি বলেন, “আরে বাবা নিজেদের মধ্যে এত তর্কাতর্কি করে কি লাভ হবে, তার থেকে ওকে কিছু বলার দরকার নেই। এসেছে যখন পুজো দেখুক, ও তো নিজের মতোই থাকছে কাউকে তো কিছু বলছে না, আমরাও ওকে ঘাঁটাব না, এখন এ নিয়ে কথার আর প্রয়োজন নেই। পুজো কাটুক তারপর না হয় দেখা যাবে। এখন চলো সবাই, অনেক কাজ আছে, এই ঋজু চল চল আর দেরি নয় চল।”