গতকাল রনিতা উত্তেজনায় প্রথমদিকে অতটা তলিয়ে ভাবেনি, তবে রাত্রে একা ঘরে শুয়ে যতই ভেবেছে আর একটা দিক উঠে এসেছে ওর ভাবনায় এবং সেটা ভালো কিছু নয়।
আচ্ছা রনিতা আর তমালের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে ওর বাবা যদি তমালের কোনো ক্ষতি করে তখন? এই প্রশ্নটা বারবার রনিতার সুখস্বপ্নের দোরগোড়ায় এসে করাঘাত করতে থাকে। রনিতার নিজের বাবা বলেই সে ভালো করে জানে যে নিজের ভাবনায়, ধারনায় আঘাত লাগলে বাইরে থেকে নিপাট ভালোমানুষ দেখতে আখতার সাহেব ঠিক কতটা সাংঘাতিক হতে পারেন। এই যে রনিতার উদারচেতা মনোভাব, এই পুজোয় মেতে ওঠা, এই সবের জন্য তাকে প্রথম দিকে কতটা শাসন সহ্য করতে হয়েছিল। শুধু তাকেই নয় তার মাকেও, কারণ এই জাতপাত আর ধর্মান্ধতার অসুর বধ করে তার মনের নরম মাটিতে আলোর বীজটি সর্বপ্রথম বপন করেছিলেন ওই মানুষটিই, তার মা। কিন্তু অসুর বধ কী এত সহজ? নয় বোধহয়, তাই তো বাবার মনের অন্তরে আজও তারা একচেটিয়া ভাবে আধিপত্য বিস্তার করে বসে আছে। আর এই অসুরগুলোকে এবার রনিতাও ভয় পাচ্ছে। আগে এতটা পেত না তাই তো লড়াই করার সাহস সে ধরে রেখেছিল, তবে এবার পাচ্ছে। ভালোবাসা যেমন মানুষকে ভীতিহীন করে তেমনই ভালোবাসার মানুষের ক্ষতির আশঙ্কা মানুষকে দুর্বলও করে। তাই আজ নবমীর সন্ধ্যায় রনিতা তমালকে বলেই বসল, “তোমার সাথে সম্পর্কটা আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বোধহয় সম্ভব নয়।”

তমাল শুনে প্রথমটা খুব অবাক হল, একরাতের মধ্যে এমন কী হল যে রনিতা নিজের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল— এটা তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না। এবার রনিতা সবটা খুলে বলল তমালকে, বলল তার দুশ্চিন্তার কথাও। সব শুনে তমাল বলল, “দেখ রনিতা, তুই অমূলক ভয় পাচ্ছিস। তাছাড়াও এখন সময় পালটেছে, এখন এসমস্ত জাতপাত কেউ এত মানে না। তাছাড়াও কাকু কেন বুঝতে পারছেন না বলতে পারিস? বুঝবে আমরা যদি বোঝাই অবশ্যই বুঝবে। আর একটা কথা তুই এখন সাবালিকা, তুই একটা সিদ্ধান্ত নিলে কারও অধিকার নেই তোর উপর জোর খাটিয়ে সেটাকে বদলানোর। তাই আমার মনে হয় কোনও সমস্যা হবে না। উত্তরে রনিতা বলল, “সব জায়গায় কি নিয়ম কানুন খাটে। তাছাড়া পাপাকে তুমি চেনোই, তার কথা অমান্য করলে তিনি কতদূর যেতে পারেন। সেই সেবারে পাপা নিষেধ করার সত্ত্বেও বন্ধুদের সাথে নাইট-স্টে করেছিলাম, মম্ ব্যাপারটা জানত কিন্তু পাপাকে জানাইনি, পরে জানতে পেরে মম্-এর গায়ে হাত তুলেছিল মানুষটা। নিজের স্ত্রী বলে শাসনের খামতি ঘটেনি। সেখানে তুমি তো পরের ছেলে। না গো, তোমার যদি কিছু ক্ষতি হয়ে যায়, এই রিস্কটা আমি নিতে পারব না।”
তমাল চুপটি করে কথাগুলো শুনল, তারপর কতকটা অভিমানের স্বরে বলে উঠল, “জানিস আমি ভাবতাম আমিই বেশি ভীতু, এতটাই যে নিজের মনের কথাটা সহজ করে তোকে বলতে এতটা সময় লেগে যাবে, তবে আমার থেকে বেশি ভীতু হয়তো তুই। এই যে বাইরে তুই প্রচলিত অন্ধবিশ্বাসগুলোকে ভাঙার জন্য এত কাজকর্ম করিস, সাহস দেখাস কিন্তু ভিতরে ভিতরে তুই একটা ভীতু। আমি তো তাও একটা চেষ্টা করেছি, তুইতো একটা চেষ্টাও না করে হার মানতে চাইছিস। কেউ একজন আমায় বলেছিল ভালোবাসতে গেলে একটু সাহসী হতে হয়। কথাটা খুব সত্যি জানিস, এই সাহসটুকু না থাকলে বাধা বিপত্তির চোখে চোখ রেখে নতুন শুরুটা করা যায় না। তুইও জানিস আমার বাড়িতে জানলেও ব্যাপারটা মানবে না। আমার বাড়ির লোক বাইরে প্রোগ্রেসিভ হোক না কেন ভেতর সেই বস্তাপচা মেন্টালিটি। তবু তো আমি ভয় পাচ্ছি না, তবে তুই কেন…? তুই হয়ত ঠিকই বলেছিস আমাদের সম্পর্কটা আর এগানো উচিত নয়।”
বলেই তমাল হনহন করে সেখান থেকে চলে গেল। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রনিতার বুক কাঁপিয়ে।