ঋজু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই আরও একটা গলা শোনা গেল, “তুই ঋজু না, কেমন আছিস?”
সামনের যে মানুষটির থেকে প্রশ্ন এসেছে তাকে দেখে ঋজু প্রথম কেমন হকচকিয়ে গিয়েছিল। তবে তার অনুমানই সত্যি, অবশেষে সে ফিরেছে, এতগুলো বছর পর, অবশেষে শ্রী ফিরেছে। ততক্ষণে আরও কয়েকটা কথা ধেয়ে আসে ওদিক থেকে, “কীরে, আমাকে দেখে যে পুরো স্টাচু বনে গেলি ভূত দেখার মতো।”
হ্যাঁ, ভূত দেখার মতোই বলা চলে কিংবা বলা যায় ভূত দেখলেও এতটা অবাক হত না ঋজু। সেইবার যখন কলেজের ছেলেটার সাথে শ্রীর ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের এমএমএস ভিডিয়োটা ছড়িয়ে পড়েছিল আর তা নিয়ে পাড়ায় একটা হইচই পড়েছিল, পাড়ার সবাই মিলে চড়াও হয়েছিল ওদের বাড়িতে। শ্রীর বাবা মানে শ্যামলবাবু প্রচণ্ড কড়া ধাতের মানুষ, একটাও কথা শুনতে চাননি মেয়ের, মা-মরা মেয়েটাকে পাড়ার লোকেদের সামনেই বেধড়ক মেরেছিলেন, এতটাই যে শ্রীর কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছিল, তারপর মেয়ের মুখের সমানেই তাকে মৃতা ঘোষণা করে বাড়ি থেকে বের করে দেন আর বলেন যে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি মেয়ের মুখদর্শন করতে চান না। শ্রীর তরফ থেকে একটাও সাফাই তিনি শুনতে চাননি। অবশ্য শ্রীও যে সাফাই দেওয়ার খুব একটা চেষ্টা করেছিল তাও নয়। শুধু রাতটুকু বাড়ির সামনে রাস্তায় কাটিয়ে ছিল শ্রী, সকাল হতেই চলে যায় সে।
“কী রে, কোথায় হারিয়ে গেলি?”
উড়ে আসা টুকরো কথাটুকু ঋজুকে এক লহমায় বর্তমানে এনে ফেলল। সেই প্রথম প্রশ্নটা ছাড়া বাকি কথাগুলো হয়ত তার কানে ঢোকেনি, সে বলল, “আমি আছি, ভালোই, তুমি?”

আগে ঋজু শ্রীকে তুই বলে ডাকত, তবে মাঝখানের বছরগুলো পরস্পরকে অনেকটা অচেনা করে দিয়েছে তাই বোধহয় তুইটা আর সহজে মুখে এলো না। উওর এল, “আমিও আছি রে।”
—“তা আজকাল কী করছিস, তুই তো বলতিস জার্নালিস্ট হবি, ওই লাইনেই কি আছিস?”
—“না, আমি আজকাল ক্যাফে সামলাচ্ছি, আমার নিজের, সাউথের দিকে।”
কথা বলতে বলতে ঋজু লক্ষ্য করল যে মুখটাকে সে বছর সাতেক আগে চিনত তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটার মুখের সাথে সেই মুখের মিল থাকলেও খুব সামান্য। তবে চোখ দুটো, হ্যাঁ, চোখ দুটো এখন একই রকমই আছে, সেই একই রকমের নিষ্পাপ, গভীর এবং মায়াবি, ঠিক সাত বছর আগেকার মতো।
শ্রী যখন থেকে মণ্ডপের ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে তখন থেকেই সেখানে উপস্থিত পাড়ার লোকেদের মধ্যে চাপা একটা গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে। ঋজু আঁচ করতে পেরেছ, শ্রীও পেরেছে, তাই হয়তো তার মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করতে শুরু করেছে। হঠাৎ ঘোষ জেঠিমা ঋজুর কাছে এসে দাঁড়াল, চোখের দৃষ্টিতে একটা রোষের ভাব। শ্রীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “ঋজু , এখানে দাঁড়িয়ে খোশগল্প করার দরকার নেই, চলে আয় ওদিকে অনেক কাজ আছে।”
ঋজু চকিতে একবার শ্রীর দিকে দেখে নিয়েই বলল, “জেঠিমা তুমি যাও, আমি আসছি।”
কিন্তু ঘোষ জেঠিমা নাছোড়, তিনি বললেন, “না তোকে নিয়েই যাব, চল কাজগুলো সারতে হবে।”
শ্রী এবারে প্রশ্ন করল, “কেমন আছেন জেঠিমা?”
ভারী বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, “আমার কথা ছাড়, তুই এখানে কেন?”। শ্রী পাল্টা প্রশ্ন করল, “কেন আসতে নেই নাকি?”