“ঋজুদা, বলছি যে বোধনের সময় তো হয়ে গেল ঠাকুর মশাইয়ের এখনও পাত্তা নেই তুমি একটু ফোন করে দেখো না।”
বিল্টুর গলার স্বরটা শুনে ঋজু ফিরে তাকাল, সে প্যান্ডেলের সাউন্ড সিস্টেমটা পরীক্ষা করে দেখছিল তমালের সাথে, ইষৎ বিরক্ত মিশ্রিত স্বরে বলে উঠল, “ওফ্, তোদের দ্বারা যদি একটা কাজও ঠিক মতো পাওয়া যায়, এই তোর বলার সময়, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?” বলেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোনটা বের করে সেভ নম্বররের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত নম্বরটা খুঁজতে লাগল। কয়েক সেকেন্ড পর ফোনটা কানে লাগিয়ে বলল, “রিং করেই যাচ্ছে, ফোন ধরছে না, বলেছিলাম এই মালটাকে নিসনা, নিলেই ঝোলাবে, এখন হল তো, প্রত্যেক বছরই এই এক কেস, কাজের সময় ব্যাটার পাত্তা পাওয়া যায় না, খালি লেট আর লেট, দূর …” বিরক্তির বিস্ফোরণ হিসেবে বেরিয়ে আসা অশ্রাব্য শব্দটাকে কোনোমতে গিলে ফেলল ঋজু, ফের বিল্টুর দিকে চেয়ে বলল “ওদিকের জোগাড়যন্ত্র সব ঠিক আছে?” বিল্টু উত্তরে জানাল “আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, ওসব নিয়ে চিন্তা নেই, ও সব ডোনা বউদি আর তোমার মা মিলে সামলে নিয়েছে, কিন্তু…” বিল্টুর মনের ভাব বুঝে ঋজু বলে, “আচ্ছা দাঁড়া আমি দেখছি, দূর আর ভাল্লাগে না, নেহাতই প্রত্যেক বছর পুজো করেন তাই, নইলে এবছর খেদিয়ে দিতাম…” ইত্যাদি গজগজ করতে করতে চলে গেল।

২১ পল্লীর সর্বজনীন দুর্গা পূজা এ বছর ৫০-এ পা দিল, তাই এই আসন্ন তৃতীয় ঢেউ এর পরিস্থিতিতেও নয় নয় করেও বেশ জবরদস্ত আয়োজন। তোড়জোড়ও অনেক ছিল, আর এবছর সমস্ত দায়িত্বে ছিল পাড়ার ইয়ং ব্রিগেড। দায়িত্বটা দিলেন অখিলেশ রায়, পাড়ার মাথাও বলা চলে তাকে। পাড়ার সবার আপদে বিপদে প্রয়োজনে এমনকি অপ্রয়োজনেও ইনিই সবার আগে এগিয়ে যান। তার মতে, “আমরা তো অনেক বছর সামলালাম, এখন এই বুড়ো হাড়ে আর ছোটাছুটি সয় না; তাছাড়াও ছেলে ছোকরাগুলোকে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে না! নইলে আগামী দিনগুলোতে করবে কে এসব? সবকটা তো ল্যাজেগোবরে হবে।” অর্থাৎ যে কথা সেই কাজ। আর এদের সামলানোর দায়িত্ব পেল ঋজু। ঋজুর ছোটোবেলা এবং বড়োবেলা সবই এপাড়ায় কেটেছে, তার বাবা নামকরা একটা কলেজের প্রফেসর, রাশভারী মানুষ, পুজোয় চারটে দিন ছাড়া পাড়ার কোনোব্যাপারে তাঁকে পাওয়া যায় না, তিনি পড়াশোনা আর তার আন্ডারে কাজ করা রিসার্চ স্কলারদের থিসিস অ্যানালিসিস নিয়ে ব্যস্ত। প্রফেসর গৃহিণী অর্থাৎ ঋজুর মা অবশ্য একটু অন্যরকম তিনি হাসিখুশি সদালাপী মানুষ, পাড়ার সব কাজে তার উৎসাহ প্রবল। পাড়ার মাহিলা মহলে বিশেষ পরিচিতি এবং অনেকের ঈর্ষারও কারণ বটে। তাঁর গানের গলাটি ভারি মিঠে। পাড়ায় কানাঘুষোয় শোনা যায় এই গানের গলা শুনেই রাশভারী প্রফেসর সাহেব কাত হয়েছিলেন।
এবছর চাঁদা তোলাটাই একটা মস্ত বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বড়োরা সবাই হাত তুলে দিয়েছেন আর ছোটোরা চাঁদা চাইতে গেলেই ঘোরাচ্ছে। এই যেমন ঘোষ জেঠিমা তো মুখের ওপর বলেই দিলেন, “এ বছর বুবুনের একটু হাত টান চলছে রে, ছেলেটা এখনো টাকা পাঠাতে পারেনি, বেশি চাঁদা ধরবি না কিন্তু, একটু কম করে নে এবারটা।” বুবুনদা মানে ঘোষ জেঠিমার ছেলে, বড়ো কোম্পানির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, লাখ লাখ ডলার কামিয়েও হাতের টান কমাতে পারছে না, আবার ঘোষ জেঠিমা যার কিনা কচি পাঁঠা ছাড়া রোচে না, পদ্মার ইলিশ ছাড়া অন্য কিছু ঘরে ওঠে না আর দু’পা হাঁটতে গেলেই এসি গাড়ির দরকার সেই তিনিও চাঁদার নামে আঁতকে উঠছেন। তমাল একবার বলেছিল, “কম বলতে কতটা ধরব বলুন না, আপনি যতটা পারবেন ততটুকুই দেবেন, আমরা মাথা পেতে নেব।”
এই ‘কতটা কম’ কথাটাকে জেঠিমা বড্ড সিরিয়াসলি নিলেন এবং ততটা কম হলে চাঁদার টাকার অঙ্কটা রশিদেও লিখতে লজ্জা হয় তারও কিছুটা কম বললেন। বিল্টু অবশ্য প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, তমাল সামলে নেয়, ঘোষ জেঠিমার গলাটি জবরদস্ত, সমে পড়লে আবার ওদের তার কেটে যাবে। আবার তরুণ মিত্র মানে পাড়ার মিত্রকাকু সরকারি অফিসের বড়ো চাঁই, অথচ চাঁদা আনতে গেলেই, “এখন একটু বেরোবে রে তাড়া আছে, পরে আসিস কিংবা, “তোদের কাকিমাকে রাজি করা, সে বললেই সব হবে, বুঝিস তো এই বছর তো একটু হাতটান তাই তোদের কাকিমা একটু গাইগুই করছে।”
মিত্র কাকু মিত্র কাকিমা না জিজ্ঞেস করে প্রশ্বাসের পর নিঃশ্বাস ও ছাড়েন কিনা সন্দেহ, তাই বলে চাঁদা না দেওয়াটাও বউয়ের ঘাড়ের ওপর দিয়ে চালাবেন! তবে এই সমস্ত ব্যাপার সামলাতে শেষ পর্যন্ত ঋজুর ডাক পড়ে।