Recent Post

অসুর মর্দন(দ্বিতীয় পর্ব): জিৎ সরকার

অসুর মর্দন(দ্বিতীয় পর্ব): জিৎ সরকার

(আগের পর্বটি পড়ুন)

এছাড়াও অন্য কিছু সমস্যাও রয়েছে, এ বছরে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেছিলেন ঋজুর মা। সেখানে মা দুর্গার বিভিন্ন রূপ বর্ণনা নিয়ে ও সবশেষে মাহিষাসুর বধ নিয়ে একটা নৃত্যনাট্যের আয়োজন করা হল। ডোনা বউদি সবে এক বছর হল বিয়ে করে এ পাড়ায় এসেছে, এই এক বছরে পাড়ার কচিকাঁচাদের নিয়ে একটা নাচের স্কুল ও খুলেছে, দুর্গার রোলটা তাকেই দেওয়া হল। দুর্গা তো ঠিক হল কিন্তু মুশকিল হল অসুরকে নিয়ে, পাড়ার ঠাকুরপোদের উৎসাহের অভাব ছিল না—তা বলাই বাহুল্য কিন্তু কাউকে ঠিক মানাচ্ছিল না, শেষ পর্যন্ত অসুর ঠিক হল অন্য পাড়ার, অনিমেষদা, নামকরা অ্যাথলেট শুধু নাচটাই তালিম দিয়ে নিতে হবে এই যা। তবে এবার বাধ সাধল মলয়দা, ডোনা বউদির পূজনীয় পতিদেব। অন্য পাড়া থেকে অসুর এসে তার অমন সুন্দর দুর্গার হাতে বধ হবে এ মনে হয় সে বেচারা সহ্য করতে পারেনি, তাই মলয়দা উঠে পড়ে লাগল অসুর সাজার জন্যে, এমনকি এও হুমকি দিলো তাকে না নিলে সে ডোনা বউদিকেও পাঠ করতে দেবে না। শেষ পর্যন্ত অসুর যা দাঁড়াল বাংলা সিনেমার রোগা কমেডিয়ানের যমজ ভাইকে সাজালে যেমন হয় ঠিক তেমনি। আবার পাড়ার দুই যমজ বোন বর্ষা ও বৃষ্টি ‌দুজনেই পাড়ার জাতীয় ক্রাশ সায়নের সাথে ডুয়েট গায়তে চাই। আসলে তাদের দুই বোনের সব কিছুর মধ্যেই খুব মিল, তবে ক্রাশের ব্যাপারটাতে মিল হয়ে যাওয়াতে পূজোর আগে তাদের সম্পর্ক আর গানের পারফরমেন্স দুটোয় ক্রাশের মুখে আর কি। তো ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যার সমাধান করে ষষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌছোনো গেল তখন এই ঠাকুর মশাই নিয়ে বিভ্রাট। এই সমস্তের পর ব্যাপারটা তখন ষষ্ঠী পর্যন্ত পৌঁছাল তখন এই পুরুত বিভ্রাট।

দশ মিনিট পর ঋজু যখন ঠাকুর মশাইকে প্রায় বগলদাবা করে নিয়ে ফিরল তখন সাত নম্বররের বাড়িটার দিকে চোখ পড়তেই খানিকটা থমকাল ঋজু। বাড়ির সদর দরজায় যে মস্ত তালাটা সচরাচর ঝুলতে দেখা যায় সেটা আজ নেই, আরও খানিকটা খেয়াল করতেই বুঝতে পারল দোতলায় রাস্তামুখো জানালার পাল্লা দুটো ঈষৎ খোলা। তবে কি সে ফিরল এই এতদিন পরে?

       আজ বারোয়ারী আকাশে সপ্তমীর সুর, ফুল ফেজ়ে পুজো শুরু আজ থেকে। তমাল সপ্তমী পুজোর জিনিসগুলো ফর্দের সাথে মিলিয়ে দেখছিল। প্যান্ডালের মাইকে তখন বাজছে ‘দো ন্যায়না অউর এক কাহানি/ থোরা সা বাদল, থোড়া সা পানি, অউর এক কাহানি’,  তমাল মন্ডপ থেকে নিচে নেমে আসতেই ঘোষ জেঠিমা বললেন “হ্যাঁরে তমাল, আজ তো অল্প কয়েকজন অঞ্জলি দেবে, ফুল দূব্বো সব যথেষ্ট এনেছিস তো?”  

—“হ্যাঁ জেঠিমা সব ঠিকই আছে, তবুও তুমি একটু দেখে নিয়ো” বলতে বলতেই তার চোখ পড়ল প্রবেশদ্বারের দিকে,  একঝাঁক প্রজাপতি ঢুকছে মন্ডপে, তাদের মধ্যে রনিতা— জিন্স আর সালোয়ার পরে, পনিটেইল করে চুল বাঁধা মেয়েটি, তাকে দেখলেই কেমন বিভোর যায় তমাল, কেমন ভ্যাবলার মতো মুখে একটা হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এই এখন যেমন তমালের হার্টবিট, রনিতার চোখের ইশারার সাথে তাল মিলিয়ে তার গতি বেড়েই চলেছে। রনিতাও‌ বোঝে ব্যাপারটা,  প্রশ্রয়ও দেয় একটু আধটু কিন্তু এর বেশি এগোতে সাহস হয় না। কারণ, কারো কারোর কাছে বড্ড ক্লিশে এই সময়ে, রনিতা আখতারের সাথে তমাল সেনের প্রেম এবং সেখান থেকে কোনও এক সময়ে শুভ পরিণয়, এমনটা তো আজকাল আকছার দেখা যায়। তা দেখা যায় বটে, কিন্তু গোঁড়ামি এখনো যে দেশের মজ্জায় মজ্জায়, এখনো যেখানে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি আর বিভেদ হয়, অনার কিলিং -এর  দৃশ্য খুবই গর্বের সাথে সোস্যাল মিডিয়ায় আপলোড হয়, সেই দেশের কোনও এক কোনায় এক শিক্ষিত পরিবেশেও এরকম কিছু ক্লিশেড কারণ অনেকটা বড়ো হয়ে থেকে যায়। তাছাড়াও এই যে রনিতা প্রতি বছর অঞ্জলি দেয় এতেও  পাড়ার অনেক সেকেলে মানুষদের ভ্রূতে ভাঁজ পড়ে,  প্রথম বছর তো রনিতা একরকম বাবার সাথে ঝামেলা করেই অঞ্জলি দিয়েছিল। এ নিয়ে তাদের বাড়িতে প্রচন্ড অশান্তি, রনিতাকে মারও খেতে হয়েছিল ওনার কাছে, কিন্তু রনিতাও বড্ড জেদি, নিজের অবস্থান থেকে একটুও সরবে না । শেষে তমাল আর ঋজু গিয়ে খুব কষ্টে আখতার সাহেবকে শান্ত করেন সামান্য অঞ্জলি দেওয়ার মূল্য রনিতার গালে সাতদিন ছাপ রেখে গিয়েছিল, যদি রনিতা জীবনসঙ্গীটা তার অমতে পছন্দ করে তবে তাকে কী মূল্য চোকাতে হবে?

তবুও প্রেম খানিকটা ঋতু চক্রের মতো, নিজের নিয়মে তার আবর্তন ঘটে। সেই আবর্তনের টানে পড়েই বুঝিবা তমাল এগিয়ে যায় রিনিতার দিকে, জিজ্ঞেস করে, “কীরে কাল যে ঠাকুরের বোধন হল, তোকে তো একবারের জন্যেও দেখলাম না।” 

রনিতা হেসে বলল, “কাল তো কলেজের বন্ধুদের সাথে বেরিয়েছিলাম গো সারাদিন ঘুরেছি, ফিরতেও বড্ড দেরি হয়েছে, তুমি বুঝি আমায় খুঁজছিলে?” 

তমাল বলল, “ঠিক তা নয়, তোকে দেখলাম না তাই আর কি, আজও কী বন্ধুদের সাথে প্ল্যান?”  

রনিতা ফের হেসে বলল, “ছিল তবে আমি ক্যানসেল করে দিয়েছি, আজ এখানেই গ্যারাজ করব ভাবছি।” 

কয়েক সেকেন্ড তমাল কী যেন ভাবল তারপর আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল, “বলছি কাল তো অঞ্জলি দিবি, তো কোন শাড়িটা ফাইনাল করলি?” 

রনিতা  ঈষৎ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী ব্যাপার বলো তো এতকিছু জানতে চাইছ?” 

তমাল ঈষৎ অপ্রস্তুত, “না মানে এমনিই আর কি। ”

এবার রনিতার মুখে অন্যরকম একটা হাসি ফুটলো, এ হাসির অর্থ নির্ধারণ একমাত্র মা দুর্গার ক্ষেত্রেই সম্তব, সে বলল, “আমার ফেভারিট কালার” বলেই হঠাৎ করে ঘুরে বাইরের দিকে হাঁটা দিল। তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তমাল। হঠাৎ কানের কাছে “এবার না হয় দুগ্গা দুগ্গা বলে মনের কথাটা বলেই ফেল, আর কদ্দিন ঝুলিয়ে রাখবি” শুনেই ঘুরে তাকালো তমাল, দেখল ঋজু দাঁড়িয়ে, কে জানে কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছে ওদের। তমাল মুখটা নিচু করে বলল, “ঋজুদাদা তুমি তো সবটাই জানো।”  

ঝজু বলল, “আরে পাগলা জানি বলেই বলছি, অনেকদিন এই করেই চলছে, আর কতদিন, এবার একটু সাহস কর, জানিস না গালিব বলে গেছেন, “এ ইশক নেহি আসান/এক আগ কা দারিয়া হ্যায় ঔর ডুব কে জানা হ্যায়।” অবশ্য তোরা ঠাকুর কেই জানলি না ঠিক করে গালিব কোথা থেকে জানবি।” 

এই সাহসের কথাটা ঋজু কি শুধুমাত্র তমালকেই বলে নাকি নিজেকেও মনে করিয়ে দেয়, দেয় একটু সান্তনা, মা দুর্গাই জানেন।

(ক্রমশ)

Author

  • জিৎ সরকার

    নবতরু ই-পত্রিকার একদম জন্মলগ্ন থেকে নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন তাঁদের মধ্যে লেখক জিৎ সরকার অন্যতম। ১৯৯৭ সালে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এরপর বাল্যকাল এবং বড়ো হয়ে ওঠা নদীয়ার করিমপুরে। স্থানীয় করিমপুর জগন্নাথ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে কৃষ্ণনাথ কলেজে জীববিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে করিমপুরেই থাকেন পেশায় ও নেশায় ছাত্র জিৎ সরকার। একই সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন লেখালেখির কাজও। জীববিদ্যাতে প্রথমশ্রেণিতে স্নাতক জিৎ সরকারের শখ প্রধানত লেখালেখি করা তছাড়াও বই পড়া, গান শোনা সিনেমা দেখা, রান্না করা, পুরোনো ইতিহাস ঘাটাঘাটি করা প্রভৃতিতেও উৎসাহ চোখে পড়ার মতো। তাঁর লেখালেখির জীবন শুরু কবিতা দিয়ে। তারপরেও কিছু কবিতা লেখা হয়েছে। তার মধ্যে কিছু সোস্যাল মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। দুটি কবিতা দুটি ওয়েব ম্যাগাজিনেও প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখি চলছে সমান তালে। এছাড়া ছবি আঁকা, ক্রিমিনোলজি সর্ম্পকে ধারনা প্রভৃতি বিষয়েও বিশেষ দক্ষ তিনি। তীক্ষ্ণ স্মৃতিধর জিৎ সরকারের লেখায় বুদ্ধিদীপ্তের ছাপ পরে লেখার পরতে পরতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার (১/১২ পর্ব)
গদ্য- সাহিত্য গল্প ধারাবাহিক গল্প

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার

    গাড়িটা যখন বড়ো গেটের সামনে এসে দাঁড়াল তখন শেষ বিকেলের সূর্য পশ্চিমাকাশে রক্তাভা ছড়িয়ে সেদিনকার মতো সন্ধ্যেকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    অসুর মর্দন(একাদশ পর্ব): জিৎ সরকার
    গদ্য- সাহিত্য গল্প ধারাবাহিক গল্প

    অসুর মর্দন(একাদশ পর্ব): জিৎ সরকার

      ভিড়টা মোড়ের বাঁকে অদৃশ্য হতেই শ্রী ঘরের দিকে ফিরতে উদ্যত হল, হঠাৎ নীচের দরজায় আওয়াজ উঠল। বাধ্য হয়েই অভিমুখে বদলে শ্রী নীচে এসে দরজা খুলল। দেখল ঋজু দাঁড়িয়ে, মুখে একটা হাসি খেলছে। এই হাসিটা একদিন ফিরে এসে শ্রী কিন্তু লক্ষ্য করেনি

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      ধারাবাহিক গল্প

      অসুর মর্দন(১০ম পর্ব): জিৎ সরকার

        এতক্ষণে তমাল মুখের কঠিন রেখাগুলো অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে, সে মৃদু হেসে বলে, “দ্যাখ পারব কি পারব না সেটা তো এখনি বলা যাচ্ছে না, তবে হ্যাঁ, একটা চেষ্টা করে দেখাই যাক, পরেরটা না-হয় পরেই বুঝে‌ নেব।

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন