Recent Post

অন্য পথে: শান্তশ্রী দত্ত

অন্য পথে: শান্তশ্রী দত্ত

ফোনের ওপারে একটা ক্লান্ত কণ্ঠস্বর….. —”হ্যালো,কেমন আছিস?”

প্রথমটা একটু বিরক্ত বোধ করে….”কে আপনি?”

(মনে মনে কিছুটা রাগ সংবরণ করেই বললাম)

একটা কৌতুকের হাসি হেসে অন্য প্রান্ত থেকে শুনলাম… “আমি মৈনাক”

মস্তিষ্ককে ৩৬০° সক্রিয় করে গুগল লিস্টে  ‘মৈনাক’ নামটি কয়েক সেকেন্ড খোঁজা খুঁজি করে ব্যর্থ হয়ে বিরক্তির পারদ আরও একটু চড়িয়ে বললাম, “রং নাম্বার”

—”আরে শোন শোন, রাখিস না আমি মৈনাক…রঘুনাথপুর হাইস্কুল…এ-সেকশন, সেকেন্ড বেঞ্চ…বৃন্দাবন স্যার…”

একটার পর একটা সার্চ-ইঞ্জিন কাজ করছে আমার…

অন্ধকার থেকে ধূসর… ধূসর থেকে ঝাপসা হয়ে ….কিছুটা স্পষ্ট হচ্ছে…

বিরক্তিটা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এখন।

জিজ্ঞাসা করলাম, “তুই সেই ‘ঢপবাজ’ তো?”

এবার একটা তৃপ্তির হাসি শোনা গেল।

—”কেমন আছিস বন্ধু?” বলল মৈনাক।

আমি তো বেশ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? কোথায় আছিস? কী করছিস এখন? বিয়ে করেছিস?

উত্তরের আশা না করেই একটার পর একটা প্রশ্ন করে চলেছি।

উত্তর এলো….

—”আমি এখনও বেঁচে আছি রে…”

উত্তরটা কেমন যেন কানে বাজলো। তবুও সেটাকে ইগনোর করেই পরের প্রশ্নগুলোর উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

একই সঙ্গে স্কুলের সেই দিনগুলো যেন গ্যালারির মতো মাথার মধ্যে স্ক্রল হচ্ছে।

মনে এক অদ্ভুত কৌতূহল, তার সঙ্গে আনন্দ….

ক্লাসে বরাবর টপ করতো মৈনাক, অনেক স্বপ্ন ছিল ওর চোখে, কিন্তু ওর অদ্ভুত এক খারাপ স্বভাব ছিল। মিথ্যা কথা যেন ওর মুখেই সৃষ্টি হত। অর্থনৈতিক অবস্থা ওর পরিবারের তেমন ভালো ছিল না কিন্তু দু চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল অনেক আশা ছিল। খুব জানতে ইচ্ছা করছে ও এখন কি করছে? ওর দেখা স্বপ্নগুলো আদতেও সত্যি করতে পেরেছে কিনা!

টিউশন এর নোটগুলো ওকে দেওয়ার বিনিময়ে আমাদের পুরো গ্যাং-এর সঙ্গে ওর একটা এগ্রিমেন্ট হত, সেটা হচ্ছে মাঝে মাঝে আমাদের পুরো গ্যাং ওর একচালা বাড়িতে হাঙ্গামা করতে যেতাম। শুধু দাবি ছিল কাকিমার হাতে মেখে দেওয়া একটি মাঝারি সাইজের বাটিতে এক বাটি মুড়ি চানাচুর পেঁয়াজ।

ওফ……… এতগুলো বছরের এই জীবন সংগ্রামে এই গদ্যগুলো যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। আজ একটা ফোনে সব যেন কোথায় থেকে মাথার মধ্যে ভিড় করছে।

কলেজের সময় মাঝেমধ্যে এক-আধবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সেটা করতে পারিনি তার একটা অপরাধবোধ আজ নিজের মধ্যে কাজ করছে তবুও এক বুক আশা আছে আজ মৈনাক নিশ্চয় স্বপ্নগুলোকে সত্যি করতে পেরেছে। এইসব এতকিছু ভাবছি এর মধ্যে হঠাৎ মৈনাক বলে উঠলো….”কী রে, চুপ করে গেলি যে….”

কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা ভেঙে আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথায় আছিস এখন?”

মৈনাক উত্তর দিল, “মেদিনীপুরে আছি।”

মৈনাকের দেওয়া উত্তর আর আমার মধ্যে তৈরি করে নেওয়া উত্তরগুলোর সঙ্গে মিল খুঁজে পেলাম না। ওর তো এখন মেদিনীপুরে থাকার কথা ছিল না।

ওর যে অনেক স্বপ্ন ছিল, অনেক ইচ্ছে ছিল, আর ছিল স্বপ্নগুলোকে সত্যি করার জন্য অনেকটা ইচ্ছে শক্তি।

—”কী করছিস ওখানে? বিয়ে করেছিস? কাকু কাকিমা কোথায় থাকেন?” আমি আবার প্রশ্ন করলাম

ও একটা কৌতুকের হাসি হেসে বলল…. “সব বলছি….”

আমি না কিছুতেই মেলাতে পারছি না ওর এই শান্ত স্বভাবটা। চিরদিনের জন্যই ছিল ভীষণ ছটফটে, প্রাণবন্ত।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মৈনাক বলল, “আমি এখন একা  বন্ধু…”

প্রতিটা সেকেন্ডেই মৈনাকের কথাগুলো যেন আমার মধ্যে কৌতূহলের মাত্রা দ্বিগুণ করে দিচ্ছে।

—”কোথায় চাকরি করছিস মৈনাক?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

—”চাকরি না, তবে একটা কাজ করছি…” উত্তর দিল মৈনাক।

—”মজা করিস না তো! সে আমরা প্রত্যেকেই কাজ করছি। বল না কোথায় কাজ করছিস?” খুব রাগ এর সঙ্গে জানতে চাইলাম ওর কাছে।

তৃতীয় দীর্ঘনিঃশ্বাসটি ছেড়ে মৈনাক বলল, “বলছি সব…স্কুল শেষে তোরা সবাই আলাদা আলাদা হয়ে গেলি, বাবার শরীরটাও ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ল, কলেজে ওঠার পর জীবনের চরম বাস্তবতা আমার স্বপ্নগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে দিতে থাকল রে। তবুও আমি চালিয়ে যাচ্ছিলাম আমার মতো করে। সারাদিনে চারবেলা টিউশন করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের শেষে বাবা মারা যায়। নিজের দেখা স্বপ্ন গুলোকে বাবার চিতাতে পুড়িয়ে কাজের খোঁজ শুরু করি। হাওড়ার একটা কাপড়ের কারখানাতে কাজ পাই সেখান থেকে একটু একটু করে নিজেকে সামলে গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করি। মা বাড়িতে একা, শরীরও তেমন ভালো যায় না। সংসারের চাপে বিয়ে করি।” এটা বলে আবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে মৈনাক।

এদিকে আমি মৈনাক সম্পর্কে নিজের কল্পনাগুলো একটার পর একটা ভাঙতে ভাঙতে চুপ করে গেছি।

কিন্তু সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে আবার প্রশ্ন করলাম….  “তারপর?”

মৈনাক আবার শুরু করল….

“যে মাইনেটা পাচ্ছিলাম বেশ চলছিল, দু’বছরের একটা মেয়েও হয়েছিলো। নিম্ন মধ্যবিত্তের নিজের সামর্থের মধ্যে নতুন করে স্বপ্ন দেখে যতটুকু ভালো থাকা যায় আমরা ততটাই ভালো ছিলাম। কিন্তু গত বছর যখন করোনা একটার পর একটা দেশকে গ্রাস করছিল তার থাবা আমার পরিবারেও আসে। প্রথমে আমি তারপর একে একে আমার মা আমার স্ত্রী আর আমার দুই বছরের ছোট্ট মেয়েটির করোনার গ্রাসে জড়িয়ে পরি। এক দিকে লকডাউন এর জেরে কাজ চলে গেছে সেই সময় বাড়ির সবাইকে নিয়ে কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।”

আমি মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম ….. “তারপর?”

—”তারপর তো সব শেষ বন্ধু…” মৈনাক বলল।

—”মানে? কী বলছিস তুই? কী শেষ?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

—”আত্মীয়-স্বজন প্রত্যেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল রে। আঠারো দিনের জীবন সংগ্রামের কাছে প্রথমে মা পরাজিত হয় তারপর আমার দু’বছরের বাচ্চা মেয়েটা হঠাৎ করেই আমাদের ছেড়ে চলে যায়। কী করবো? কীভাবে নিজেকে সামলাবো? কীভাবে নিজের স্ত্রীকে সামলাবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারছিলাম যুদ্ধটা বোধহয় আমি হারতে বসেছি। একে করোনা অন্যদিকে নিজের মেয়েকে হারানোর কষ্টটা আমার স্ত্রী আর নিতে পারেনি। সাতষট্টি দিনের মাথায় আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে যায়……!” বলল মৈনাক

এত কিছু শুনে আমি নিজেকে সান্ত্বনা দেব না কি মৈনাককে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। পরে কোনো প্রশ্ন আমি আর করতে পারছি না কিন্তু জানতে ইচ্ছা করছে। এরপর মৈনাক নিজেই বললো..

—”আমি এখন মেদিনীপুরে আছি রে বন্ধু। নিজের পেটটা তো চালাতে হবে?”

ওর এই প্রশ্নে সায় জানানোর শক্তিটুকু আমার মধ্যে নেই..।

এর পরে যে আমার জন্য আরও কিছু অপেক্ষা করে ছিল সেটা ভবিনি। কারণ এর পরের কথাটা আমাকে ভেঙে চুরমার করে দিল।

মৈনাক বলল, “আমি এখন লাংস ক্যান্সারের পেশেন্ট রে বন্ধু”

—”তাহলে ট্রিটমেন্ট?” আমি জানতে চাইলাম।

— “একটা এন.জি.ও আমার ট্রিটমেন্ট করার দায়িত্ব নিয়েছে। তবে লাস্ট স্টেজ রে।” বলেই একটা তৃপ্তির হাসি হাসলো মৈনাক।

আমি আর পারছিলাম না। ঈশ্বরের উপর থেকে শেষ পঁচিশ মিনিটে সব বিশ্বাস তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি আমি।

এমন সময় আমার পাশে আমার পাঁচ বছরের মেয়ে এসে বললো “বাবা আমার অনলাইন গানের ক্লাস আছে মোবাইলটা দাও….”

কথাটা মৈনাক শুনতে পেয়ে বললো….”আচ্ছা বন্ধু আজ রাখি, ভালো থাকিস”

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না, ফোনের লাইটটা জ্বলে উঠল, বুঝলাম ফোনটা কেটে দিয়েছে। মোবাইলটা মেয়ের হাতে দিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আর ভাবতে থাকলাম, “এই ভাবেই কত স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে……”

—”ভালো থাকিস মৈনাক।”

Author

  • শান্তশ্রী দত্ত

    নবতরু ই-পত্রিকার লেখক ও ফটোগ্রাফার শান্তশ্রী দত্ত জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯০ সালে। তিনি নবতরুর পত্রিকার একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই যুক্ত আছেন। ফটোগ্রাফিতে তাঁর হাত বেশ পাকা, একই সঙ্গে লেখালেখিতেও বেশ আগ্রহ আছে তাঁর। স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ শান্তশ্রী দত্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন শিক্ষা বিভাগের কর্মী হিসাবে নিযুক্ত আছেন।

2 thoughts on “অন্য পথে: শান্তশ্রী দত্ত

  1. ভাল হয়েছে । করোনা আমাদের জীবনে এমনই বিরহ এনেছে । গল্পে এর প্রতিফলন হয়েছে । পাঠক দের করোনা যুদ্ধে সামিল করবে । স্মৃতি রোমন্থন ভালো হয়েছে । ধন্যবাদ শান্তশ্রী ।

  2. এ ভাবেই আনেক স্বপ্ন হারিয়ে যায়। ভালো লাগলো গল্পটা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

গ্রীষ্মের দিনের টুকরো কথার স্মৃতি: প্রিয়াংকা রায়
গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

গ্রীষ্মের দিনের টুকরো কথার স্মৃতি:

    ছেলেবেলায় গ্রীষ্মকাল কেমন ছিল সেটা ভাবলে খুব যে কষ্ট পেয়েছি তা মনে নেই, তবে কষ্ট কমানোর উপায়গুলো বেশ মনে পড়ে। একটু আলাদা মত যেটা, সেটা একটু বলি।

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    শৈশবের গরমকাল: সরোজ চট্টোপাধ্যায়
    গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

    শৈশবের গরমকাল: সরোজ চট্টোপাধ্যায়

      একটু জ্ঞান হতেই মুক্ত গ্রাম্য প্রকৃতির কোলে শৈশবের অনাবিল আনন্দধারায় ভাসতে শুরু করেছে জীবন

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার (১/১২ পর্ব)
      গদ্য- সাহিত্য গল্প ধারাবাহিক গল্প

      আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার

        গাড়িটা যখন বড়ো গেটের সামনে এসে দাঁড়াল তখন শেষ বিকেলের সূর্য পশ্চিমাকাশে রক্তাভা ছড়িয়ে সেদিনকার মতো সন্ধ্যেকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন