অতৃপ্ত পরিহাস(অস্ফুট সম্ভাষণ/১ম পর্ব): দীপ্তেশ চট্টোপাধ্যায়
আমার নাম সুশীল উপাধ্যায়। পেশায় একজন অতি সামান্য লেখক মাত্র। একা মানুষ থাকি কোন্নগরে। লেখালেখির শখ বহুদিন থেকেই কিন্তু কোনোদিন যে এই নিরঙ্কুশ ভালোবাসা নিজের জীবন পরিচালনার মাধ্যম হয়ে উঠবে তা ভাবিনি। এই লেখার নেশায় মত্ত হয়ে উপযুক্ত পরিবেশ আর প্লটের সন্ধানে কতই না জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি তার ঠিক নেই। আমার লেখার যা বিষয়বস্তু তা নিয়ে একটু বিতর্কের অবকাশ থাকলেও এর রসনাতৃপ্তির থেকে খুব কম জনই বোধহয় বঞ্চিত হতে চায়। হ্যাঁ একদম ঠিক ধরেছেন, আমি ওই “তেনাদের” নিয়েই একটু লেখালেখি করি। এই “তেনাদের” অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় যতই থাকুক না কেন, বর্ষণমুখর দিনে কোন অজানা অচেনা রহস্যময় আস্তানায় একাকী রজনীযাপনের অভিজ্ঞতা আর তার সাথে যার অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় তার আগন্তুককে সম্ভাষণ যে কীরকম হতে পারে তার একটা চিত্রপট তুলে ধরার জন্যই লিখতে বসা। এই একটি ঘটনা আজ মনে সেই সংশয়ের কোনও অবকাশ রাখেনি, শুধু রেখে গেছে তার ভয়াবহ প্রাসঙ্গিকতা। কোনোদিন কাউকে বলা হয়নি সেই ভয়াবহ ভবলীলার পৈশাচিক কদর্যতার কাহিনি। আজ বলছি। কাজেই গৌড়চন্দ্রিকা করে আর বাক্যব্যয় করছি না এবার চিত্রপটের মূলস্রোতে আসা যাক।
লেখাটা যে আমার নেশা আর পেশা সেকথা আগেই বলেছি। সেবার বেশ কিছুদিন জ্বরে ভুগে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। হাতে বেশ কয়েকটা লেখার কাজ ছিল সেগুলোর কাজও ভালো করে অগ্রসর হয়নি। অসুস্থ শরীরে মাথাও ঠিকঠাক কাজ করছিল না আর শহরের যান্তব আর্তনাদ যেন অসহ্য হয়ে উঠছিল ক্রমশ। দিনে দমফাটা গরম আর সন্ধের পর গুমোট অস্বস্তিতে গলদঘর্ম হয়ে মানসিকভাবে প্রায় বিপর্যস্ত যখন হয়ে পড়েছি তখন ডাক্তার দত্ত বললেন, “ওহে সুশীলচন্দ্র, যাও যাও কোনও মনমুগ্ধকর পরিবেশে একটু জল হাওয়া বদলে এসো, তোমার শরীর আর মন দুই চাঙ্গা হয়ে যাবে।”

যুক্তিসংগত মনে হল ডাক্তারের পরামর্শ, বড্ড একঘেয়েও লাগছিল কয়েকদিন ধরেই। তাছাড়া বহুদিন ধরে ভাবছিলামও একাকী কোথাও একটু অবসর কাটিয়ে আসব। কিন্তু কোথায় যে যাব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, এইসব কথাই আলোচনা করছিলাম আমার এককালের কলেজের সহপাঠী বিকাশের সাথে। কলেজের পাঠ বহুকাল আগে শেষ হয়ে গেলেও বিকাশের সাথে সখ্যতা বিন্দুমাত্র কমেনি।
-“কী করা যায় বলতো, কাছাকাছি কোনও নিরিবিলি, শান্ত, স্নিগ্ধ, মনোরম জায়গা তোর জানা আছে?”
– “কেন এতো ভাবছিস বলতো তুই হয়তো ভুলে গেছিস আমাদের একটা পৈতৃক বাড়ি আছে আজিমগঞ্জের অদূরে বসন্তনগরে। অসাধারণ জায়গা! চারিদিকে যেমন স্নিগ্ধ কোমল প্রকৃতি তেমন সবুজের আহ্বান। ক’দিন কাটিয়ে আয় তোর ভালো লাগতে বাধ্য।”
-“শুনে তো এখনই যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সেখানে এখন কে থাকে?”
– “আরে ভাই আমাদের সেরম সেখানে যাওয়া না হলেও, সুবিমলকাকু তো থাকেন আর দেখশোনা করেন। তুই শুধু কবে যাবি বল আমি সব ব্যবস্থা করে রাখছি।”
-“আহা বহুদিন ধরে এরমই একটা জায়গার সন্ধানে ছিলাম। আমি পরশু যাচ্ছি তুই বলে দে।”
-“বহুত আচ্ছা লেখকবাবু।”
বেরিয়ে পড়লাম অবশেষে হাওড়া থেকে সোজা কাটোয়া আর সেখান থেকে ট্রেন বদল করে আজিমগঞ্জ স্টেশনে নামলাম। নবাবের দেশ মুর্শিদাবাদের মাটিতে পা দিলাম বহুদিন পরে। স্টেশনে সুবিমলবাবু ছিলেন সঙ্গে একটা মোটর ভ্যান ভাড়া করে এনেছিলেন। বয়স্ক ভদ্রলোক বেশ অমায়িক। যেন মনে হল কতকালের পরিচিত। ওনার মুখেই শুনলাম বিকাশদের এই ভিটে নাকি নবাব আলিবর্দি খানের আমলের আর ওদের পিতৃপুরুষদের কেউ নাকি নবাব দরবারের গোমস্তার একজন কর্মী ছিলেন। সেই সূত্রেই এই বিশাল ভিটের পাওনা নবাব দরবার থেকেই। আজও যা কত জানা অজানা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলছে। যেতে যেতেই এইসব বাক্যালাপ চলছিল সুবিমলবাবুর সাথে। বসন্তপুর পৌঁছলাম যখন বৈশাখের সূর্য তখন মধ্যগগনে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সে এক বিরাট তিন মহলা অট্টালিকা। সামনেই পুরোনো আমলের বিরাট তোরণ। মনে হল সেই বহু পুরোনো কোনও এক সময়ে প্রবেশ করেছি। সময় যেন এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। বহুকাল রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই সুবিশাল অট্টালিকায় বাহ্যিক চাকচিক্য না থাকলেও ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরার ধ্বজা আজও বহন করে নিয়ে চলেছে। বাড়ির পিছনে একটা পুকুরঘাট যদিও তার যত্রতত্র ইঁট সুরকি খসে পড়ছে, কোথাও আবার নয়নতারা গাছের চারা উঁকি দিচ্ছে। পুকুরের চারপাশে কতরকম গাছ তারমধ্যে নারকেল গাছই বেশি। সবমিলিয়ে ছায়াঘেরা শান্তস্নিগ্ধ পরিবেশে পা রাখার সাথে সাথেই মেজাজটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। আর এটা ভেবে আনন্দ হল যে এই হল ভৌতিক গল্পের জন্য কলম ধরার আদর্শ পরিবেশ। পথের ক্লান্তি দূর হল ঠান্ডা জলে স্নান করার পর। দুপুরের খাবার এল সুবিমলবাবুর বাড়ি থেকেই। বাটি চাপা ভাত, আম দিয়ে ডাল, আলু পোস্ত, কাতলা মাছের কালিয়া আর চাটনি সহযোগে এক জমাটি আহার সারলাম। ইতিমধ্যে দুবার বিকাশ ফোনে কুশল সংবাদ নিয়েছে।
-“তা আপনি এখানে কতদিন ধরে এখানে আছেন সুবিমলবাবু?”
– “আমি তো এই বসন্তপুর গ্রামেরই বাসিন্দা আর এই বাড়ির সাথে বহুদিনের সম্পৰ্ক। বিকাশের বাবা আমার বাল্যবন্ধু। ছোটবেলায় এখানেই তো মানুষ হয়েছে। তারপর ওরা সপরিবারে কলকাতা চলে গেল আর এই বিশাল বাড়িটির দেখভালের ভার আমায় দিয়ে গেল। সেই থেকেই খেয়াল রাখি। ওরা সব পরিচর্যা আর পরিচালনা বাবদ কিছু অর্থ পাঠায় তাতেই সব চলে।”
যাইহোক আমার খাওয়া হলে পর উনি নিজের বাড়ি চলে গেলেন আর রাত্রে আবার একবার আসবেন জানিয়ে গেলেন। আমার দরকারের জন্য একজন গ্রামেরই ছেলেকে রেখে গেলেন সে নিচে কোণার ঘরটিতে থাকবে। সারাদিনের ক্লান্তি যেন দুচোখে তখন নেমে আসছিল। দিবানিদ্রার অভ্যেস নেই তথাপি একটু শয়নে যেতেই হল।
বিকেলের দিকে বাড়িটা নিপুণভাবে পরিদর্শন করতে বেরোলাম। বেশ বনেদিয়ানার স্পর্শ রয়েছে আনাচে কানাচে। তিন মহলা বাড়ির সিংহভাগই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠেছে চারিদিকে আনাচে কানাচে আগাছা গজিয়ে উঠেছে কিন্তু তবুও যেন এই মহলের প্রাণ আছে বোধ হল। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই সুবিশাল অট্টালিকার প্রতিটি উপকরণ যেন কিছু বলতে চায়। বৈশাখের অন্তিম বেলায় পরন্ত রোদে মায়াময় এক স্তব্ধতা অনুভব করছিলাম। এই রক্তাভ আবির রংয়ের স্তব্ধতারও যে কিছু বলার থাকতে পারে জাগ্রত উদ্দীপনায় তা বোধহয় সেই প্রথম অনুভব করলাম। ঘরে ফেরা পাখির কলরবে মুখরিত গোধূলি যেন অন্তর্যামী হয়ে আমার সেই ভাবনাকে স্বীকৃতি দিল। সামনের বারান্দা পেরিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদ অবধি। সেদিকে এগিয়ে ছাদে উঠলাম। একরাশ মুক্ত দখিনা বাতাসের স্পর্শে হঠাৎ যেন কেমন একটা শিহরণ খেলে গেল। কোন এক অজানা ভয়ে একটু থমকে দাঁড়ালাম। কেউ যেন আমায় অনুসরণ করছে স্পষ্ট বুঝতে পারছি। সে যেন আমার চারপাশেই রয়েছে। আমার সমস্ত গতিবিধি সে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। আমি সেটা অনুভব করছি এখানে পা রাখার পর থেকেই। তবে কি মনের ভুল! হতে পারে হয়তো। প্রাকসন্ধেঘন মুহূর্তে বসন্তপুর গ্রামের মনোরম পরিবেশ প্রত্যক্ষ করলাম। দূরে কল্লোলিনী ভাগিরথীর বুকে যাত্রিবাহী নৌকো পারাপারের ক্ষীণ স্বর ভেসে আসছিল। ঘরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা যেন ক্রমেই গ্রাস করছিল সেই বাড়ির চারপাশকে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেইস্থানে। হঠাৎ আচমকাই ছাদের খোলা কপাটটি সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। সন্ধ্যার রঙ তখন বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে। চারপাশটা একবার দেখে নিলাম। শান্ত স্থির পরিবেশ। সশব্দে কপাট বন্ধ হয়ে যাবার উপযুক্ত ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না। যাইহোক সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে দেখলাম ঘরে দুটো মোমবাতি জ্বলছে। এখানে বলা বাহুল্য এখানে সন্ধের পর থেকে লোডশেডিং হয়ে যায়। ঘরে এসে বসতেই সুবিমলবাবু এলেন।
-“এখানে এই এক সমস্যা। বেশ কিছুদিন হল সন্ধে হলেই আলো নিভে যায়। বুঝতে পারছি তোমার একটু অসুবিধা হবে। একটু মানিয়ে নেবে কষ্ট করে।”
– “আরে না না কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। গরম আজকে একটু কম আর তাছাড়া এখানকার জল হাওয়াও বেশ লাগছে।”
কথায় কথায় রাত হয়ে এল। সুবিমলবাবুও উঠে পরে বাড়ি যেতে উদ্দত হলেন আর আমিও ওনার বাড়ি থেকে আসা মুরগির ডালনা আর গরম গরম চাপাটি আত্মসাৎ করে কলম ধরলাম। লেখার কাজ যতটা হয় এগিয়ে রাখা যায় আরকি। ইতিমধ্যে যে ছেলেটির আমার সাথে থাকার কথা সে খোঁজ নিয়ে গেছে আর এক ঘটি জল রেখে গেছে।
রাত ক্রমশ গভীর হল।
(ক্রমশ)
“অতৃপ্ত পরিহাস” এর শুভারম্ভ খুবই আনন্দদায়ক।
ক্রমশ তে যাবার আকাঙ্ক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ।