অতৃপ্ত পরিহাস(অশরীরীর চক্রব্যূহ/২য় পর্ব): দীপ্তেশ চট্টোপাধ্যয়
(আগের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন)

মোমবাতির প্রজ্জ্বলিত শিখার অস্পষ্ট আলোকে দেওয়ালে টাঙানো এই বংশের কোন এক জমিদারের দশাসই সুবিশাল তৈলচিত্রটি কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছিল। হয়ত সেই ভাবনারই সমর্থনে একটি টিকটিকি কোথাও ডেকে উঠে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল। চমকে উঠলাম। চারিদিকে যেন অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতার আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত হয়ে রয়েছে। রূপকথার গল্পের মতো কেউ যেন ধরাধামে এক মরণকাঠি স্পর্শ করে দিয়েছে বোধ হল। এই নিস্তব্ধতার যে এরকম আকর্ষণের ক্ষমতা থাকে তা সেদিন বুঝেছিলাম। লেখার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম কিন্তু একাগ্রতার অভাবে ঠিক আশানুরূপ হচ্ছিল না। দক্ষিণের বিশাল জানালাটা খোলা ছিল। মনমুগ্ধকর শীতল বাতাসে মন প্রাণ যেন জুড়িয়ে এল। এখানে বলা বাহুল্য যে সময়ের কথা আমি বলছি তখন মুঠোফোনের রমরমা এত ছিলনা। যাইহোক লেখা ছেড়ে খোলা জানালাটির দিকে এগিয়ে গেলাম। এগিয়ে গেলাম বলব নাকি কোন অদৃশ্য বিভীষিকার মোহময়তায় এগিয়ে গেলাম বলতে পারব না। কিন্তু কিছু একটা যে ঘটতে চলেছে তা বেশ বুঝতে পারলাম। হঠাৎ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। সুষুম্নাস্নায়ুর মধ্যে দিয়ে শীতল এক প্রবাহ বয়ে গেল। কারণ ঠিক তখন আমার অনুভূতি হতে লাগল কেউ যেন ঠিক আমার পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে ওই জানালার সামনে। তার প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাসের তপ্ত আভাস আমার ঘাড়ের উপর এসে মিলিয়ে যেতে লাগল। কোনও এক অদৃশ্য প্রতিমূর্তির নাগপাশে নিজের হৃৎস্পন্দন অনুভব করলাম। চারিদিকে অন্ধকার আরও ঘণীভূত হয়ে এল। আকাশের ঈশান কোণে বিদ্যুৎ ঝলক দিতে লাগল। আমি স্থির নিস্পন্দ। নড়াচড়ার শক্তি যেন লোপ পেয়েছে। দূরে নদীর ওপার থেকে একসাথে কতগুলো শেয়াল তারস্বরে ডেকে উঠল। রাস্তার কুকুরগুলো একটানা কেঁদেই চলেছে। সবমিলিয়ে প্রকৃতি যেন কোন অশুভ অমঙ্গলসূচক বার্তার আভাস দিচ্ছে। ঘরে অশরীরির উপস্থিতি এবার আরও সুস্পস্ট হয়ে উঠল। টেবিলে রাখা জলের ঘটি হঠাৎ উল্টে গেল। কাউকে ডাকার শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে। মোমবাতির আলো ক্রমে ক্ষীণতর হয়ে এল। সারাদিনের ক্লান্তি যেন সবকিছু ভুলিয়ে দিতে চাইছিল। কাজেই ঘুমোতে যাবার উপক্রম করছিলাম। ঠিক সেই সময় ঈশান কোণে পুঞ্জিভূত হতে থাকা মেঘের মধ্যে থেকে বজ্রনিনাদ ধ্বনিত হতে লাগল। আকাশ বাতাস যেন তার সাথে মেতে উঠল এক উন্মত্ত লীলাখেলায়। কর্ণপটহ বিদীর্ণ করা ঘন ঘন বজ্রপাতের সঙ্গী হয়ে আকাশ যেন ভেঙে পড়ল তার বারিধারার সাথে। ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সে কি বর্ষণ। চারপাশে নিকশ কালো অন্ধকার যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। সেদিনের সেই রাত্রির অব্যক্ত রূপ মনের মধ্যে অনেক আশঙ্কার উন্মেষ ঘটাচ্ছিল। সবকিছুই যেন ইঙ্গিতপূর্ণ মনে হচ্ছিল। ঘড়িতে তখন রাত বারোটা। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে। ঘরের মধ্যে এক অন্ধকারের পর্দা টানা রয়েছে মনে হল। চোখের দুটি পাতা জুড়ে এসেছিল ঠিক তখনই মনে হল কেউ যেন আমায় ঝুঁকে পড়ে দেখছে একদৃষ্টে। ঘুমের ঘোরেই এক ভয়ার্ত আর্তনাদ বেরিয়ে এল। তারপর আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল। কে যেন আমার পা ধরে নিচের দিকে নামানোর চেষ্টা করে চলেছে। সেই হিমশীতল স্পর্শ যে সেই সময় কি অনুভূতির সঞ্চার করেছিল তা কখনই ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বাইরে তখনও মেঘের গর্জন প্রতিফলিত হচ্ছে। খোলা জানলার পর্দা উন্মত্ত সিক্ত বাতাসে এলোমেলোভাবে উড়ছে। নিবিড় আঁধারে সেই সময় মনে হচ্ছিল যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করেছি। যেখানে প্রতি মুহূর্তে এক অজানা অদেখা কোন আতঙ্কের হাতছানি। বিছানার ওপাশ ফিরে শোবার উপক্রম করতেই যে দৃশ্য চোখের সামনে দেখলাম তা ব্যাখ্যা করতে আজও কেমন আতঙ্ক লাগছে। সেই অসুন্দর, হৃৎস্পন্দন স্তব্ধকারী দৃশ্য মানসপটে উদ্ভাসিত হোক তা বোধহয় কাম্য নয়।
আমি দেখলাম এক নারীমূর্তি তার ললাটময় এক বিরাট সিঁদুরের ফোঁটা আর মুখমন্ডলে অজস্র কাটা দাগ এক বীভৎসতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। হাড় হিম হয়ে গেল। রক্ত শীতল করা সেই অপলক দৃষ্টি।
আচমকাই সেই আবছা মূর্তি আকাশ বাতাসে কম্পন ধরিয়ে অট্টহাসি করে উঠল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অস্ফুটে জিজ্ঞাসা করলাম:
– “কে তুমি?”
ক্রমশ…..