অতৃপ্ত পরিহাস:(অন্তিম নাগপাশ/তৃতীয় পর্ব): দীপ্তেশ চট্টোপাধ্যয়
(আগের পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)
বলার সাথে সাথেই যেন চারপাশের অন্ধকারটা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মনে হল অস্পষ্ট অথচ তীব্র অনুভূতি জাগানো এক মায়াবী মহিলা কন্ঠস্বর যেন কাঁদছে। তারপর আচমকাই একদম নিশ্চুপ, একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে চলছে। পুকুরে ব্যাংগুলোর বিরামহীন ডাক তার সাথে পাল্লা দিচ্ছে। বৃষ্টিটাও ধরে এসেছে কিছুটা। তবে মাঝে মাঝে মেঘের বুক চিরে বিদ্যুৎ নির্গত হয়ে অন্ধকারকে খান খান করে দিচ্ছে। বিছানাতেই বসে ছিলাম। নামবার শক্তি যেন লোপ পেয়েছে। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন কি এক আকর্ষণে আমায় সেখানে আটকে রেখেছে। স্পন্দনহীন ভাবে বসে রইলাম আর ঠিক তখনই যা ঘটল সেটা লিখতে আজও আমার হাত কাঁপছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের আলোয়

খোলা জানলার দিকে চোখ গেল। সারা শরীর অবস করে সেই মুখ আবার উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। উফ্! সে কি ভয়ানক। সহ্য করা যায়না। শুধু মুখমণ্ডল, আর কিচ্ছু না। সারা দেহ অদৃশ্য। শুধু সেই কাটা বীভৎস অশ্রুসজল মুখমণ্ডল। পুনরায় বিদ্যুৎ ঝলকে দেখলাম সেই স্কন্দকাটা মুখ আরও আমার দিকে এগিয়ে এসেছে। এভাবে সেটা আমার দিকে ক্রমে এগিয়ে আসতে লাগল। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। চারপাশ সম্পর্কে উদাসীন। সেই মুখ যেন আমার অন্তরাত্মাকে পর্যন্ত সম্মহিত করে ফেলেছে। তারপর সেই মুণ্ডুটা আমার চারপাশে প্রদক্ষিন করতে লাগল আর চাপাস্বরে কাঁদতে লাগল। অন্ধকারে চারদিক ধুয়ে মুছে গেছে। ঘরের মধ্যে একের পর এক বস্তু ওলোট পালট হয়ে যেতে লাগল। যেন দীর্ঘদিনের চেপে রাখা কোনো ক্রোধ লাভা উদগীরণ স্বরূপ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কপাট জোড়া বারংবার খোলা আর বন্ধ হতে লাগল। খাট বিছানা সব দুলতে লাগল। অমঙ্গলের লেলিহান শিখায় সব ধ্বংস হয়ে যাবার জোগাড়।
একটা মরাপচা গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। যেন পচিত গলিত কোন এক নরদেহ কাছেই কোথাও পড়ে রয়েছে। বাইরে নিশাচর পাখিগুলো আচমকা ডানা ঝটপট করে বিভৎস এক আর্তনাদ করে উঠল। অশনি সংকেতের বার্তা যেন ঘর থেকে দালান সর্বত্র প্রতিফলিত হতে লাগল। ফিরে ফিরে আসতে লাগল সেই কান্না আর সেই মুখমন্ডল আরও ভয়ানক হয়ে উঠতে লাগল। সারা শরীরে শিহরণ জাগিয়ে আর আমার হৃদস্পন্দন প্রায় স্তব্ধ করে দিয়ে সেই পিশাচিনী আমার গাল স্পর্শ করল। এক ভয়ার্ত আওয়াজ অজান্তেই বেরিয়ে এলো। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কোনোরকমে দৌড়ালাম; দালান পেরিয়ে উপরে যাবার সিঁড়ি, সিঁড়ি পেরিয়ে ছাদে চলে এসেছি বুঝতে পারলাম। মেঘ কেটে তখন অন্তিম প্রহরের একফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে সাথে অতি শীতল ঝোড়ো বাতাস। বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি যেন কোনো কদর্য পাশবিক মুহূর্তের প্রতিটি প্রহর গুনছে। দূরের নারকেল গাছের সারি যেন প্রবল আগ্রহে কোনো অমানবিক ঘটনার আঘাত হানার প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষারত। পিছনে ধাওয়া করে আসা সেই স্কন্দকাটা মূর্তি হটাৎ যেন অট্টহাসির হিল্লোল তুলে উঠল। ছাদের একদম শেষ প্রান্তে এসে হোঁচট খেয়ে সংজ্ঞা হারালাম।
সুবিমলবাবুর ডাকাডাকিতে জ্ঞান এল। চোখ মেলে দেখলাম বিছানায় শুয়ে আছি আর আমায় ঘিরে বেশ কয়েকটা চিন্তিত জিজ্ঞাসু মুখ। প্রথম সকালের কাঁচা সোনা রঙের রোদ্দুর ঘরের এক কোণে এসে পড়েছে। চারপাশ পাখিদের কূজনে মুখরিত। সুবিমলবাবু প্রশ্ন করলেন,
-“এখন ঠিক আছ? আর একটু হলেই কী সর্বনাশটাই না হয়ে যেত!”
কাল রাতের সব ঘটনা আবার মনে পড়ে যেতেই আতঙ্কে ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে গেলাম। কিন্তু কোমড়টায় ব্যাথার কামড় দিয়ে উঠল।
-“আরে করো কি। চুপ করে শুয়ে থাকো কিচ্ছুক্ষণ। তারপর সব কথা শুনছি।”
এরপর গ্রামের এক ডাক্তার এসে আমায় দেখে গেলেন। গায়ে হাতে পায়ে প্রবল যন্ত্রণা। ডাক্তারের পরামর্শে এবেলা বিশ্রাম নিতে হবে। সেরম কিছু হয়নি একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। বেলা একটু গড়াতেই সুবিমলবাবু এলেন। বিকাশকে কিছু জানাতে বারণ করেছিলাম আমি। যাইহোক সুবিমলবাবুর বাড়ি থেকে আনা খাবার খেয়ে বেশ স্বছন্দ বোধ করলাম। উনি বললেন, “আচ্ছা তোমার চিৎকার শুনে নীচে যে ছেলেটি ছিল সে ছাদে গেয়ে তোমায় অচৈতন্য অবস্থায় গিয়ে উদ্ধার করে আর তড়িঘড়ি আমায় খবর দেয়। ঠিক কি হয়েছিল একটু খুলে বল তো?”
সেই দুঃস্বপ্ন যতটা মনে করতে পারলাম তাঁকে যথাসাধ্য বললাম।
-“আপনি হয়তো আমায় পাগল ভাবছেন বিশ্বাস করছেন না কিন্তু আমি ঠিক যা যা হয়েছিল তাই তাই বলছি।”
উনি সবটা খুব মন দিয়ে শুনলেন। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে খোলা জানলার দিকে এগিয়ে গেলেন আর বললেন, “বিকাশকে বারণ করেছিলাম তোমাকে এখানে না-পাঠাবার জন্য। যাইহোক এখন যেটা হবার সেটা তো হয়েই গেছে।”
আমি বললাম, “ঠিক বুঝলাম না?”
সুবিমলবাবু বলে চললেন তখন সুবা বাংলার মসনদে; নবাবী হুকুমত চলছে নবাব আলিবর্দী খানের। মুঘল সম্রাট মুহাম্মাদ শাহ রঙ্গীলা তখন ভারতবর্ষের সিংহাসনে আসীন। যাইহোক, সেই সময় এইসব এলাকা তাঁদেরই দখলে ছিল। আর এই বাড়ি তাঁদেরই সম্পত্তি ছিল। বিকাশের পূর্বপুরুষ সেই নবাব দরবারের একজন কর্মী ছিলেন। প্রায়দিনই এখানে জলসা আর মজলিস বসত। সারারাত চলত সেই মজলিস। বিভিন্ন জায়গা থেকে নর্তকীদের আনা হত এখানে। এই ঘরের পাশেই ছিল সেই নাচঘর। একবার এক অতি সুন্দরী এক নর্তকীকে আনা হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার সিলেট থেকে, আর সেই রাতে সুরাসক্ত কিছু উন্মত্ত রাজকর্মীর লালসার শিকার হয় ওই নিরপরাধ মেয়েটি। ঠিক এই ঘরে তাঁকে নিয়ে এসে তার উপর অকথ্য নির্যাতন করা হয় আর সবশেষে তাকে খুন করা হয় এই ঘরেই। সুবিমলবাবু থামলেন।
বাইরে দুপুরের প্রখর রোদ্দুর। একটা শুষ্ক তপ্ত বাতাস জানলা দিয়ে প্রবেশ করল। বসন্তপুরের সেই বসন্ত সপুষ্পক হলেও তা যেন হঠাৎ বেরঙিন হয়ে গেল। আবার যেন ভেসে উঠল সেই অশ্রুসজল মুখখানি। রেখে গেল সেই নৃশংসতার অতৃপ্ত পরিহাসের প্রতিধ্বনি এই শতাব্দী প্রাচীন বাড়ির প্রতিটি ধুলিকণায়, প্রতিটি ইঁট, কাঠ পাথরে। পরিহাসেরও যে কিছু ভাষা থাকে, রচনাগাথার মর্মস্পর্শী ঐক্যতান থাকে তা সেদিন অনুভব করেছিলাম। আর অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলাম তার প্রতিটি নিশ্বাসের অতৃপ্ত কলতান।